ইসরায়েলে আল জাজিরার কার্যক্রম বন্ধে এবং গাজা থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংবাদ পৌঁছানোকে সীমিত করতে রামাল্লায় আল জাজিরার কার্যালয় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত বিশ্বের স্বাধীন সাংবাদিকদের মারাত্মক সতর্কবাণী দিচ্ছে। বিশ্বের কোথাও কোনো গণমাধ্যমই নিজেদের কার্যালয়ে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত এবং মুখোশধারী নিরাপত্তারক্ষীদের অভিযানকে মেনে নেবে না।
২২ সেপ্টেম্বর ভোরে ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী সরকারের সশস্ত্রবাহিনী রামাল্লায় আল জাজিরার ব্যুরো কার্যালয়ে প্রবেশ করে সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে এবং বাজেয়াপ্ত করে সেখানে থাকা গণমাধ্যমের সামগ্রী। পরে তারা সংবাদমাধ্যমটির ফিলিস্তিন অংশের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয় এবং কার্যালয়ের প্রবেশপথে ধাতব পাত ফেলে রাখে।
মে মাসে ইসরায়েলে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধে নেতানিয়াহু মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এবার মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর এই গুরুতর আঘাত এলো। যার ফলে অধিকৃত পশ্চিম তীরে তৎক্ষণাৎ কার্যক্রম বন্ধ করতে সংবাদমাধ্যমটি বাধ্য হয়েছে। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট থাকাকালীন পাস করা এক আইনের ভিত্তিতে “জঙ্গিবাদে উস্কানি ও সমর্থন দেওয়ার” অভিযোগে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ৪৫ দিনের জন্য কার্যালয়টি বন্ধ রাখার আদেশ দিয়েছে।
গাজা এবং অধিকৃত এলাকা থেকে একমাত্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম হিসেবে আমরা সংবাদ প্রচার করায় ইসরায়েল নিরবচ্ছিন্নভাবে আল জাজিরা ও এর সাংবাদিকদের হামলার লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিভৎস রূপ, পশ্চিম তীরে অব্যাহত ধরপাকড় এবং অনুপ্রবেশের দিকে আলোকপাত করাই হয়তো আপাতদৃষ্টিতে সংবাদমাধ্যমটির অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভীতি প্রদর্শন, বাধা, হামলা, গ্রেপ্তার এবং হত্যাসহ আল জাজিরা যে ক্রমাগত হুমকির সম্মুখীন হয়েছে তা অগ্রহণযোগ্য। আমরা আমাদের অধিকার এবং আমাদের সংবাদকর্মীদের সুরক্ষার জন্য সমস্ত সম্ভাব্য আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আল জাজিরাকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানোর দীর্ঘ ইতিহাস ইসরায়েলের জন্য নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আক্রমণগুলো আরও সুসংহত এবং দুঃসাহসিক হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে নেতানিয়াহু আমাদের জেরুজালেম কার্যালয় বন্ধের হুমকি দেন৷ ২০২১ সালে গাজায় যে ভবনে আমাদের কার্যালয় ছিল, তা ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। ২০২২ সালে জেনিন শরণার্থী শিবিরে আমাদের সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গত বছরের অক্টোবর থেকে আমাদের লক্ষ্যবস্তু বানানো এবং হেনস্তা করা আরও বহুগুণে বেড়েছে। এই জুলাইয়ে আমাদের সাহসী সহকর্মী সাংবাদিক ইসমাইল আল গুল এবং ক্যামেরাপার্সন রামি আল রিফিকে গুপ্তহত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী যুদ্ধের সংবাদ প্রকাশকারী সংবাদকর্মীদের কণ্ঠরোধ করার আরেকটি পদক্ষেপ নেয়, যা কোটি মানুষের ওপর মানবিক প্রভাব ফেলে।
আমরা বিশ্বাস করি, গত অক্টোবর থেকে আমাদের সাংবাদিক সামের আবু দক্বা, হামজা আল দাহদুহ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করার মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডগুলো আল জাজিরার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে চালানো একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রচারণার অংশ।
এ ধরনের নির্মম ও নির্লজ্জ আক্রমণ শিরিন আবু আকলেহর মৃত্যুর পরও অব্যাহত রয়েছে। তাঁর শেষকৃত্যে পুলিশ হামলা চালালে তাঁর মরদেহবাহী কফিনটি মাটিতে পড়ে যায়। এবং রামাল্লায় আল জাজিরার কার্যালয়ে রবিবারের তল্লাশির পর দখলদার বাহিনী আকলেহর স্মৃতি ছবিটি ছিঁড়ে ফেলে। মৃত্যুর পরও সাংবাদিক এবং তাঁদের কর্মের প্রতি নেতানিয়াহু সরকারের বৈরী মনোভাব বহু বছরের একটি বিকৃত নীতি বাস্তবায়নের প্রতীক।
এটি সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং দর্শকদের অধিকৃত ফিলিস্তিনের গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম ছাড়াও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে কী ঘটছে তা জানার অধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালত স্বীকৃত ইসরায়েল এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে চলমান অমানবিক যুদ্ধ এবং তার বর্বরতাকে আড়ালের উদ্দেশ্যে আল জাজিরা ও অন্যান্য সকল স্বাধীন গণমাধ্যমকে চুপ করাতে ‘ড্র্যাকোনিয়ান আইন’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
আল জাজিরাকে পেশাদারি মানদণ্ড লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করা অযৌক্তিক এবং এর ক্যামেরাপার্সন এবং সংবাদকর্মীদের ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা সমানভাবে অপমানজনক। এই অভিযোগগুলো বানোয়াট ও ভিত্তিহীন, এবং আমাদের সহকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি৷
বারবার আল জাজিরার মুখ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে ইসরায়েলি সরকার নতুন আইন পাস করে ‘জরুরি অবস্থার’ কথা উল্লেখ করে নিজস্ব বিচারিক প্রক্রিয়াকেই বাধা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমটিকে চুপ করাতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর কট্টর ডানপন্থী মন্ত্রিসভা কতদূর যেতে প্রস্তুত এখন সেটিই দেখার বিষয়।
• আসিফ হামিদি, কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার ডিরেক্টর অব নিউজ।
• যুক্তরাজ্যেরদ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে ভাষান্তরে রুশাইদ আহমেদ