সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) ব্রিটিশ সরকার ইসরায়েলে দেশটির ৩০টি সামরিক যন্ত্রাংশ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ, হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং স্থল লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর উপকরণ উৎপাদন করে থাকে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি এক সরকারি অনুসন্ধানের বরাতে বলেছেন, এই উপকরণগুলো ব্যবহার করে গুরুতরভাবে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করার সমূহ বিপদ রয়েছে।
গাজার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চলমান অব্যাহত গণহত্যা উপত্যকাটিকে ‘মানবাধিকার শূন্য অঞ্চল’-এ পরিণত করেছে। বিগত ১১ মাস ধরে যারা এ সংক্রান্ত সংবাদগুলো দেখেছেন, তারা এটা বলতেই পারেন।
চলতি বছরে ব্রিটিশ সরকারের হয়ে কাজ করা আইনজীবীরা ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে কি-না, তা নিয়ে আইনি পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরে কনজারভেটিভ পার্টির এক সংসদ সদস্য আইনজীবীদের দেওয়া সেই পরামর্শের নথি দেখে ইসরায়েল আসলেই ওই ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
তবে তৎকালীন বিরোধী দল লেবার পার্টি এই আইনি পরামর্শের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশের দাবি জানালেও তা নজিরবিহীন গোপনীয়তায় অপ্রকাশিত রাখা হয়। তাই আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি, ওই বিশ্লেষণই লেবার সরকারকে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে, যদিও তা যথেষ্ট নয়। তবে আশা করা যায়, এ ধরনের ভয়ানক অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে তারা নিজেদের দায়মুক্ত করবে।
এরপরও লেবার সরকার এটিকে ইসরায়েলকে অসহযোগিতা করার কর্মকাণ্ড বলে আখ্যা দিতে নারাজ। “গভীর বেদনার” সঙ্গে সোমবারের ঘোষণাটি দেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে এটি কোনো অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা নয় বলে এক বিবৃতিতে দাবি করেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একই বক্তব্যে নিজেকে ‘উদার ও প্রগতিশীল জায়নবাদী’ বলেও বর্ণনা করেন তিনি।
তবে এ ধরনের পদক্ষেপ আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় অতি নগন্য। কারণ ৩০টি প্রতিষ্ঠানের অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স মুলতবির বিপরীতে এখনও ৩২০টি কোম্পানি বহাল তবিয়তে ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি করছে। নির্মাতাদের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্য বিশ্বের সবচেয়ে বিধ্বংসী যুদ্ধবিমান এফ-৩৫ নির্মাণের উপকরণের যোগানও দিয়ে থাকে। যা গাজায় বিমান হামলা চালাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ব্রিটিশ সরকার নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে বাদ দেয়নি।
এর মূল কারণ হলো ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানিতে যুক্তরাজ্যের ওপর ব্যাপক মার্কিন চাপ। গত সপ্তাহেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টা রবার্ট ও’ব্রিয়েন ইতিমধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যদি ব্রিটিশ প্রশাসন ভবিষ্যতে অস্ত্র রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তবে তারা কঠোর পদক্ষেপ নিবেন।
গাজা সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে লেবার এবং তার পূর্ববর্তী কনজারভেটিভ সরকার আতঙ্কিত জনমতকে ব্যাপকভাবে অগ্রাহ্য করেছে। সর্বশেষ নির্বাচনে লেবার পার্টি ইস্যুটিতে অনড় থাকায় যুদ্ধবিরোধী প্রার্থীদের কাছে বেশ কয়েকটি আসন খুইয়েছে। উপরন্তু, জুলাইয়ে দেশটিতে পরিচালিত এক জনমত জরিপে সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশ অস্ত্র বিক্রি বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন।
নতুন সরকারের জন্য এটি বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে বেসামরিক প্রশাসনিক পদধারীরা কয়েক মাস যাবৎ অস্ত্র রপ্তানির সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্ট দাপ্তরিক অবস্থানের ওপর অসন্তুষ্ট হওয়ায়। গত আগস্টের মাঝামাঝি মার্ক স্মিথ নামের এক কূটনীতিক তাঁকে বারবার অবহেলা করার অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেছেন, যিনি এই ইস্যুটির ওপর বহু বছর যাবৎ কাজ করেছেন। তার পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, “আমি আর দায়িত্ব পালন করতে পারব না— এটা জানার পরও যে, এই বিভাগ যুদ্ধাপরাধে সহায়তা করতে পারে।”
স্মিথের উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয়টি সঠিক। কারণ অব্যাহত অস্ত্র সরবরাহের কারণে বর্তমান সরকার আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এবং এটি দ্রুত ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। লন্ডনের পুলিশ ইতিমধ্যেই বিগত সরকারের মন্ত্রীদের যুদ্ধাপরাধের মদদ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছে। গত সপ্তাহে আমার সংস্থা গ্লোবাল জাস্টিস নাও এ সংক্রান্ত এক আইনি পরামর্শে ইসরায়েলি বাহিনী যে যুদ্ধাপরাধ করছে তার দায় (যুক্তরাজ্যের) বেসামরিক কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের বহন করতে হবে বলে উল্লেখ করেছে।
যদিও এই জটিলতা স্পষ্টতই অস্ত্র, সামরিক ও লজিস্টিক সহায়তা এবং বুদ্ধিমত্তা বিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা যুক্তরাজ্য ইসরায়েলকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দিয়ে চলেছে। এ ধরনের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন ফিলিস্তিনে চলমান অবৈধ দখলদারিত্বের বিস্তারে ইসরায়েলকে সহায়তা করছে।
স্পেন ও আয়ারল্যান্ডের মতো যুক্তরাজ্য কখনোই ইসরায়েলের সঙ্গে তার বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলেনি। বরং এটি অবৈধ ইসরায়েলি বসতিতে উৎপাদিত পণ্য আমদানির অনুমোদন দিয়ে এর রক্ষণাবেক্ষণের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছে।
কিন্তু তার চেয়েও খারাপ দিক হলো লেবার মন্ত্রিসভা ইসরায়েলের সঙ্গে একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তি করাকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিচ্ছে। যা একটি গণহত্যা প্রতিরোধে ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতার ব্যবহারকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছে। অধিকন্তু, আপাতদৃষ্টিতে এই অপরাধের জন্য এটি ইসরায়েলকে পুরস্কৃত করার শামিল।
তবে যুক্তরাজ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করাসহ ইসরায়েলের নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তি খাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। যা সর্বোচ্চ যুদ্ধাপরাধে জড়িত ইসরায়েলি অর্থনৈতিক অভিনেতাদের সরাসরি সহায়তা করতে পারে।
এবং এখানে আমরা কিছু ইঙ্গিত পাই যে কেন আমরা আমাদের রাজনৈতিক অভিজাতদের কাছ থেকে ইসরায়েলের প্রতি এমন পূর্ণ সমর্থন দেখতে পাচ্ছি। লেখিকা নাওমি ক্লেইন যেমন মার্চ মাসে লিখেছেন, পশ্চিমা অভিজাতরা গাজায় দেখতে পাবে যে আমাদের গভীরভাবে বিভক্ত, ভয়ঙ্কর অসম বিশ্ব কোথায় যাচ্ছে। আর এর কারণ হলো ইসরায়েলের আয়রন ডোম (প্রতিপক্ষের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী বিশেষ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা) হয়ে উঠেছে একটি নিবিড় নিরাপত্তার মডেল, যা গ্লোবাল নর্থের সরকারগুলো সমর্থন করে। মূলত এটি এমন একটি মডেল যেখানে সম্পদশালী রাষ্ট্রগুলোর সীমানা তাদের পরিচালিত ঔপনিবেশিক গণহত্যার মাধ্যমে প্রাচুর্যময় হয়ে উঠেছে তাদের ‘নিজস্ব আয়রন ডোম’-এর সংস্করণ দ্বারা। আর তাই পশ্চিমারা ইসরায়েলে সফল হওয়া এই নিরাপত্তা মডেলটিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে।
ইসরায়েলের অর্থনীতির একটি বিরাট অংশ উৎসর্গ করা হয় দখল না পাওয়া ভূখণ্ডকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে।
ইসরায়েলি বসতি উচ্ছেদবিরোধী কমিটির সদস্য জেফ হালপার বলেন:
“ইসরায়েল একটি নিয়ন্ত্রিত সংঘাত চায়। দখলকৃত অঞ্চলগুলো ইসরায়েলের জন্য একটি বড় পরীক্ষাগার, যেখানে ইসরায়েল সমরাস্ত্র ও নজরদারি ব্যবস্থার প্রযুক্তিগুলোর নির্ভুল পরীক্ষা চালাতে পারে।”
এসব বিষয় কিছুটা হলেও আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে— যুক্তরাজ্যে কেন লেবার সরকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অনিচ্ছুক। এটা আমাদের আরও বুঝতে সাহায্য করে কেন তারা অজনপ্রিয়তার বিনিময়েও আমাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতার হাত যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া একটি দেশের প্রতি প্রসারিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সর্বোপরি, তারা এমন দেশের সঙ্গে সামরিক ও প্রযুক্তিগত অংশীদারত্ব ছিন্ন করতে চায় না, যে দেশ তাদের বিশ্বাসমতে আমরা যে ক্রমবর্ধিষ্ণু বিভক্তির বিশ্বে বাস করছি তাতে আধিপত্য বিস্তার করবে।
কিন্তু পশ্চিমের মানুষদের আমাদের সরকারের এই বৈশ্বিক বর্ণবাদের অংশ হওয়ার বিষয়ে কোনো আগ্রহ থাকতে পারে না। কারণ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একই উপায়গুলো কোনো না কোনোভাবে শেষ হয়ে গেলে তা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।
সোমবারের (২ সেপ্টেম্বরের) ঘোষণা আমাদের সামনে এই সম্ভাবনা তুলে ধরে: আমরা অপরাধে সহায়তা করার মাধ্যমে জটিলতা সৃষ্টি করে চড়া মূল্য দিতে পারি। এবং এমন একটি সময়ে যখন সংবাদ দেখাটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আমাদের এই বিজয় উদযাপন করা উচিত। তবে শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্যও আমাদের চাপ বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
•মূল লেখক: নিক ডেয়ারডেন, যুক্তরাজ্যের প্রচারণা সংস্থা গ্লোবাল জাস্টিস নাও-এর পরিচালক।
•আল-জাজিরা থেকে ভাষান্তর: রুশাইদ আহমেদ
আরএস