ভসাঈদের মা মনোয়ারা নির্বাক হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে সবার দিয়ে চেয়ে আছে। মাঝে মাঝে বাবা-বাবা বলে ডাকছে। আর বাবা মকবুল হোসেনের কন্ঠে কোন কথা নেই। তিনিও সবার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
নিহত সাইদের ছোট বোন সুমির আর্তনাদ করছে আর তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলছেন,হামার ভাইকে ওরা মেরে ফেলল ক্যান? হামার ভাই বেঁচে থাকলে হামার হেরে স্বপ্ন পুরুণ হলো হয়। ও ভাইও হামাক এনা বোন কয়া ডাকো রে।তার আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
আবু সাঈদ (২৪) পরিবারের একমাত্র বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তান বাবা-মায়ের। নিজের ইচ্ছায় ৯ ভাই-বোনের মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন তিনি। অভাবের কারণে অন্য সন্তানদের লেখাপড়া করাতে না পারলেও সাঈদ খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ৫ পেয়ে এসএসসি পাস করে। পরে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসিতে একই ফলাফল নিয়ে সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন।
আজ মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) দুপুরে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনি নিহত হন। আবু সাইদ পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের মকবুল হোসেনের ছোট ছেলে।
নিহত আবু সাঈদ (২২) রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের ২০১৯- ২০ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থী।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে রংপুরে আজ মঙ্গলবার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারক আবু সাইদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী।তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরিফুল ইসলাম।
আজ বেলা দুইটার দিকে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় পুলিশের ছোড়া টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট এবং ছাত্রলীগ ইট পাটকেল ছুড়লে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন রাস্তায় এগিয়ে দেয় বুক এতে গুলিবিদ্ধ হয় আবু সাইদ।
আহত হন আবু সাঈদ। পরে তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে হাসপাতালে আনার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আশিকুল আরেফিন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, আজ দুপুরে রংপুর শহর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সমবেত হন। বেলা দুইটার দিকে শিক্ষার্থীরা প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশ অবস্থান নেয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা ছিলেন পার্ক মোড়ের দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে। পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। বেলা আড়াইটার দিকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও পুলিশ আহত হন। আহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার আগেই মারা যান বলে তার সঙ্গে থাকা অন্যান্য সমন্বয়কেরা জানিয়েছেন। আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩০ জনের মতো রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন।
এদিকে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলাকালীন বেলা আড়াইটার দিকে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশের অবস্থান, অন্যদিকে পার্ক মোড়ের দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের কর্মীরাও শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ও ফাঁকা রাবার বুলেট ছোড়ে। এভাবে ত্রিমুখী পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলে।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের সদস্য আবু সাঈদের বন্ধু অঞ্জন রায় বলেন, রাবার বুলেটের আঘাতে আবু সাঈদ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল এবং এ সময় সংঘর্ষ চলছিল। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে কিছুটা দেরি হয়।
রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, কতটি রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়া হয়েছে, তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। আবু সাঈদের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, তা ময়নাতদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরিফুল ইসলাম শিক্ষার্থী নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে রাবার বুলেটের ক্ষত রয়েছে। তবে সাঈদ কী কারণে মারা গেছেন, চিকিৎসকেরা তা বলতে পারবেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হৃদয় রঞ্জন রায় বলেন, মেডিকেলের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তির আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁর শরীরের একাধিক স্থানে রাবার বুলেটের ক্ষত রয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। কিন্তু রাবার বুলেটের আঘাতে মারা গেছেন কি না, তা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ছাড়া এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।
তবে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নিহত আবু সাইদের লাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসার পথে রংপুর নগরীর সুরভি উদ্যান পৌঁছালে পুলিশ তাত্ক্ষণিকভাবে সেখানে গিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে আবু সাইদের লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।