জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী কর্তৃক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এদিকে একই ঘটনায় আক্রমণকারীদের পাল্টা ধাওয়া করেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।এ ঘটনায় দুইজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ তিনজন আহত হয়েছেন। এছাড়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার পদত্যাগ করেছেন।
রবিবার (১৪ জুলাই) দিবাগত রাত তিনটার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এর আগে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যর প্রতিক্রিয়ায় রাত দশটার দিকে বিভিন্ন আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
এরপর রাত সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকায় জড়ো হন বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা। তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে দুইজন আন্দোলনকারীকে অবরুদ্ধ করে ফোন তল্লাশির অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এই খবর জানাজানি হলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বটতলা এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হলের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা।
এ সময় দুই শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে মোবাইল তল্লাশির ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে প্রাধ্যক্ষকে হলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখানোর অনুরোধ জানান আন্দোলনকারীরা। পরে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার। তখনো শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হলের সামনে ও ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করছিলেন।
এরপর রাত দেড়টার দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। মিছিলটি রাত সোয়া দুইটার দিকে ফের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাধা দেন এবং মুখোমুখি অবস্থান নেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর কবিরসহ কয়েকজন শিক্ষক দুই পক্ষকে থামানোর চেষ্টা করেন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের জামায়াত-শিবির আখ্যা দেন ও নারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে গালাগাল করেন।
এক পর্যায়ে রাত পৌনে তিনটার দিকে বাধা উপেক্ষা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পাল্টা ধাওয়া দেন শিক্ষার্থীরা। পরে আন্দোলনকারীরা হলের ফটকে গেলে তাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। হামলার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী ৪৬তম ব্যাচের ছাত্র প্রাচুর্যসহ বেশ কয়েকজন হামলা করছেন।
এদিকে ছাত্রলীগের হামলায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিহা আহত হয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তাও আহত হয়েছেন। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ নাজমুল হাসান তালুকদার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উস্কে দিয়েছেন। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। পরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে হলের প্রাধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলা হয়েছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি আহ্বান করি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী স্লোগান দেওয়ার কারণে তাদের আটক করে মোবাইল তল্লাশি করা হয়েছে—এমন খবর পেয়ে আমি হলের সামনে যাই। এরপর হল প্রাধ্যক্ষের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাইলে তিনি কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ছাত্রলীগকে উস্কে দেন। এ সময় ছাত্রলীগ আমাদের উপর আক্রমণাত্মক স্লোগান দিয়ে হামলা চালালে আমরা পাল্টা ধাওয়া দিই।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অর্থ সম্পাদক ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তৌহিদুল আলম তাকিদ বলেন, ‘আমাদের হলের সামনে এসে আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কারের নাম করে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগকে অবমাননা করে স্লোগান দিচ্ছিল। তখন আমরা একটা শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে যেতে চাইলে তারা বাধা দেন এবং গালিগালাজ করেন। তাদের কোনো হামলা করিনি, যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছি। আমরা হলে ফিরে যাওয়ার সময় তারা আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার বলেন, ‘আজ যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এভাবে হল চালানো সম্ভব না। আমি প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করছি।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এতো রাতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। আজ সোমবার প্রশাসনের সকলে মিলে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
অন্যদিকে আজ সোমবার উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন, এমন আশ্বাস পেয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ভোর সাড়ে চারটার দিকে নিজ নিজ হলে ফিরে যান। এছাড়া আজ সন্ধ্যা সাতটায় ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে মশাল মিছিলের ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
রবিউল হাসান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়