গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে খুলনা মহানগরী ও আশপাশের উপজেলাগুলোতে বিএনপি নেতাকর্মীদের দখল ও লুটপাটের ঘটনা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। দোকানপাট, জায়গাজমি, ঘাট, বালুমহাল ও মৎস্য ঘের দখলের অভিযোগে ভুক্তভোগীরা আতঙ্কিত।
অভিযোগ তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খুলনায় বিএনপির একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে।
এরই মধ্যে মনিটরিং সেলে প্রায় ২০০টি অভিযোগ জমা পড়েছে। দখল, লুটপাট এবং চাঁদাবাজির ঘটনায় ১০০ জন নেতাকে শোকজ এবং ২০-২৫ জন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য সার্চ কমিটিও কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন স্থানীয় নেতা।
মহানগরীর চিত্র
সরকার পতনের পর মহানগরীতে বিএনপি নেতাকর্মীদের দখলবাজি যেন লাগামহীন হয়ে উঠেছে।
খানজাহান আলী থানা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক কাজী মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে শিরোমনি বিআইডব্লিউটিএর ঘাটে ইজারাপ্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একই এলাকায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকা অর্ধ শত কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখলের অভিযোগও পাওয়া গেছে তাঁর বিরুদ্ধে। এতে সম্পৃক্ততা আছে স্থানীয় ছাত্রদল নেতা বিল্লাহরও।
তবে কাজী মিজানের দাবি, এ সকল অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
রেলওয়ে মার্কেটের ভেতরে ডাক্তারবাড়ি বলে একটি পুরাতন ভবন রয়েছে। সেটি দখল করে বিএনপি নেতারা নিজেদের অফিস স্থাপন করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তবে বিষয়টি নিয়ে সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দাবি করেছেন, এটি বিএনপির পুরোনো অফিস। ভবনটি শুধু পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।
সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালেও বিএনপিপন্থী মালিকরা জেলা বাস-মিনিবাস কার্যালয় দখল করে নতুন সমিতি গড়ে তুলেছেন। রূপসা-বাগেরহাট বাস-মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতির কার্যালয়টিও এখন রূপসা উপজেলা বিএনপি নেতাকর্মীদের দখলে।
উপজেলায় দখল ও লুটপাটের ঘটনা
সাতক্ষীরার পাইকগাছার কপিলমুনি বাজারে ৫০ বিঘা ঘের দখল এবং শতাধিক দোকান দখলের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য শাহাদাৎ হোসেন ডাবলুর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ ঘটনায় তাকে শোকজ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব মনিরুল হাসান বাপ্পী।
গত ১০ জানুয়ারি একই উপজেলার বোয়ালিয়া ব্রিজের নিকটবর্তী হিতামপুর মৌজায় ৫০ বিঘা ঘের দখলের অভিযোগ মিলেছে পৌরসভা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোড়লের বিরুদ্ধে। তবে তাঁর দাবি, অন্যরা তার নাম ব্যবহার করে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করছে।
দিঘলিয়া উপজেলায় জমি দখল এবং ফেরিঘাট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মামলাসহ সংঘর্ষের ঘটনায় উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুর রহমান মিন্টু মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
এ প্রসঙ্গে তিনি জমি দখলের ঘটনাকে ৭-৮ মাস আগে জমি কেনার দাবি উল্লেখ করলেও ফেরিঘাট দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মামলায় বর্তমানে জামিনে আছেন বলেও জানান তিনি।
গত ১৯ জানুয়ারি কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নে ১০০ বিঘা জমি দখল এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় বিএনপি নেতা সাঈদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। তবে সাঈদের ভাষ্য, এলাকায় তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এমন ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে কিছু কুচক্রী মহল।
এ ছাড়া, কয়রা সদর বাজারে দোকানে লুটপাট ও দখলের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে উপজেলা বিএনপির নুরুল আমিন বাবুলের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় নুরুলসহ উপজেলা কয়েকজন নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বটিয়াঘাটা উপজেলার দশগেটের বালুমহাল দখল নিয়ে স্থানীয় যুবদল নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে।বিএনপি নেতারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এ ছাড়া, ফুলতলা উপজেলার সিকিরহাটের মন্দিরের ঘাটটি ৫ আগস্টের পর বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ সাব্বির হোসেন রানার বিরুদ্ধে। তবে তার দাবি, স্থানীয় সনাতনধর্মীদের অনুরোধে ঘাটটি বন্ধ করা হয়েছিল। পরে তা আবার চালু করা হয়েছে।
তেরখাদা উপজেলায় এক ব্যক্তিকে মারধর করে ১৩ লাখ টাকা লুট করার অভিযোগ পাওয়া যায় স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের কাছে এ ব্যাপারে ওই ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ করলে গত ১২ সেপ্টেম্বর শোকজ করা হয় তেরখাদা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বাবু মোল্লা, সদস্য ফেরদৌস মেম্বার, গাউস মোল্লা ও রবিউল ইসলাম লাকুকে।
এ ছাড়া, ডুমুরিয়া উপজেলায় এক বিএনপি নেতার বাড়িতে আওয়ামী লীগ নেতার গাড়ি পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় স্থানীয় উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোল্লা মোশাররফ হোসেন মফিজকে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এর পাশাপাশি, রূপসা উপজেলায় জেলা কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদের নেতৃত্বে একটি প্রতিষ্ঠানে কয়েক কোটি টাকা লুট করা হয়। কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
দাকোপ উপজেলার চালনা পৌরসভার সাবেক বিএনপি নেতা শেখ শাকিল আহমেদ দিলুও যুগ্ম মহাসচিবের কাছে উপজেলার তিলডাঙ্গায় ঘের লুটের অভিযোগ এনেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতা মোজাফফর গংয়ের বিরুদ্ধে।
বহিষ্কার ও শোকজের তালিকা
বিএনপির মনিটরিং সেলের তথ্যানুযায়ী, দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ এবং নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খুলনা মহানগরে অন্তত ৫০ জন নেতাকে শোকজ এবং ২০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একাধিক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেও অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
সামনে আসছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও
প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে দখল ও লুটপাট নিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারা শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা করলেও তৃণমূলে নেতাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও ভুক্তভোগীদের অবস্থা
ভুক্তভোগীরা অনেক ক্ষেত্রে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দখলের ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও স্থানীয় প্রশাসন ও দলীয় প্রভাবের কারণে সঠিক বিচার পাচ্ছেন না।
বিএনপির অবস্থান
খুলনা মহানগর বিএনপির মনিটরিং সেলের আহ্বায়ক রেহেনা ঈসা জানান , অনেক অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রে করা হচ্ছে। তবে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে সার্চ কমিটি কাজ করছে।
আরইউএস