জাবি প্রতিনিধি :
প্রতিবছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘন কুয়াশা আর শীতল হাওয়ার সঙ্গী হয়ে শীতের বার্তা নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে অতিথি পাখি। তাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয় ক্যাম্পাস। নভেম্বরের শুরু থেকেই শীতপ্রধান অঞ্চল সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন, নেপালসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করে তারা। তবে বিগত কয়েক বছরে পাখির আগমন তুলনামূলক হারে কমেছে। কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত বহুতল ভবন নির্মাণ, সময়মতো লেকগুলো সংস্কার না করা, গাছ কাটা, লেকে মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়া, লেকের পাড়ে জনসমাগমসহ নানা অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছে পাখি গবেষক ও পরিবেশবিদরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট-বড় প্রায় ১৪টি লেকের মধ্যে পরিবহন চত্বরের পাশের লেক, ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টারের (ডব্লিউআরসি) পাশের লেক, নতুন রেজিস্ট্রার ভবনের সামনের লেক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনসংলগ্ন লেকে এসব পাখির সমাগম বেশি থাকে। কিন্তু বিগত দুই বছরে তুলনামূলকভাবে পাখি আগমনের হার কমেছে।
অতিথি পাখির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর কিছু পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করে। অক্টোবরের মধ্যেই লেকগুলোর কচুরিপানা ও আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলা হয়। লেকের পাড়ে জনসমাগম রোধে চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া এবং উচ্চশব্দ সৃষ্টি ও গাড়ির হর্ন না বাজানোর জন্য সতর্কবার্তা লিখে সাইনবোর্ড দেওয়া হয়। কিন্তু এ বছর অতিথি পাখির আগমন এবং সংরক্ষণে প্রশাসনকে সে রকম দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ‘১৯৮৬ সাল থেকে ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি আসা শুরু করে। শীতের সময় ক্যাম্পাসে ১২৬ প্রজাতির দেশীয়, ৯৮ প্রজাতির বিদেশি মিলিয়ে মোট ২০৬ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে ৭৮ প্রজাতির পাখি নিয়মিত ক্যাম্পাসে অবস্থান করে।
লেকগুলোতে সাধারণত হাঁস-প্রজাপতির অতিথি পাখি বসে। সম্প্রতি পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী মোট ১২ প্রজাপতির পাখির আগমন ঘটেছে। কিন্তু প্রতিবছর সব প্রজাতি একসঙ্গে আসে না। গড়ে তিন বা চার প্রজাতির পাখি আসে। তবে আগামী ১৯ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য পাখি মেলার আগে নতুন করে জরিপ করার পরিকল্পনা করছে বিভাগটি। যেহেতু অনেক পাখি ক্যাম্পাসে এসে আবার চলে গেছে সেক্ষেত্রে জরিপের পর ক্যাম্পাসে অবস্থানকারী পাখির সংখ্যাটি নিয়ে নিশ্চিত হবে বিভাগটি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও পাখি গবেষক অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের যে লেকগুলোতে অতিথি পাখি বসে, দুই বছর ধরে সেই লেকের মধ্যে সবগুলোতে পাখি বসে না। এর প্রধান কারণ হলো লেকের পাড়ের প্রতিকূল পরিবেশ, যা পাখিদের জন্য উপযোগী নয় । লেকগুলোর পাড়ে ব্যাপক
মানুষের সমাগম, গাড়ির হর্ণ দেওয়ার মতো বিব্রতকর পরিবেশ লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে পরিবহন চত্বরের দোকানগুলোর পেছনে বসার জায়গায় মানুষের সমাগম থাকার ফলে পাখিরা সেখানে বসছে না । গত বছরেও সেখানে পাখি বসে পরে আবার চলে গেছে। আর পাখিরা একবার যেখান থেকে চলে যায়,সেখানে পরবর্তী সময়ে বসার আগ্রহ দেখায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ ট্রান্সপোর্টের পাশের লেকের পাড়ে প্রতিকার হিসেবে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া এবং সর্তকীকরণের জন্য সাইনবোর্ড দিলে লেকের পরিবেশ পাখিদের অনুকূলে আসবে । আমরা এ নিয়ে স্টেট অফিসের সাথে কথা বলেছি, শীঘ্রই তারা এ নিয়ে যথার্থ পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছে। বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ডব্লিউআরসি-সংলগ্ন লেকে প্রথম পাখি আসে। এখনো পাখি রয়েছে সেখানে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশের বড় লেকটিতে আগে প্রচুর পাখি বসত। কিন্তু সংস্কারের অভাবে কচুরিপানায় ভরে গেছে। লেকটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সেখানে পাখি বসতে পারছে না। এ জন্য পাখি আসা কমে যাচ্ছে। বড় পরিসরের এই লেকটি পরিষ্কার করা গেলে কোলাহল থাকলেও সেখানে পাখি বসতে পারবে। ‘
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড মনোয়ার হোসেন বলেন, অতিরিক্ত কোলাহল ও ঠিক সময়ে লেক পরিষ্কারগুলো পরিষ্কার না করাই এর মূল কারণ। প্রশাসনের সাথে আমাদের এ নিয়ে কথা হয়েছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে একটি মাস্টারপ্ল্যান নিয়েও আমরা ভেবেছি, প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে দ্রুত এটি বাস্তবায়ন করলে অচিরেই সমস্যাটির সমাধান ঘটবে।
অতিথি পাখির আগমন কমে যাওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের
বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অরিত্র সাত্তার বলেন, অপরিকল্পিত নির্মাণ, এবং নগর পরিকল্পনায় প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রাধান্য না দেওয়াতে আমাদের সুদূরপ্রসারী কিছু সমস্যা শুরু হবে। সেটা মানুষের শারীরিক অসুস্থতা থেকে শুরু করে বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি ইত্যাদি সবকিছুতেই প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগরে অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে, পরিযায়ী পাখি থেকে শুরু করে সকল ধরনের বন্যপ্রাণীর সংখ্যা হঠাৎ কমে আসছে। এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে পরিবেশ বান্ধব নীতি প্রণয়ন একটি সময়ের দাবি।
তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসে বর্তমানে এক প্রজাতির বুনো হাঁস, চার প্রজাতীর পরিযায়ী রেপটর এবং ছয় প্রজাতির জলজ পরিযায়ী পাখির দেখা মিলছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায়, পাখির সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। অতিরিক্ত মানুষের ছড়াছড়ি ও পরিবেশ দূষণ এর অন্যতম কারণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট শাখা জানায়, ‘এ বছর অতিথি পাখি আগমন উপলক্ষে সময়মতো লেকগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। লেকের পাড়ে নিরপত্তাবেষ্টনী এবং সতর্কবার্তা সাইনবোর্ডও টানানো হয়েছে।অতিরিক্ত লোকসমাগম ও কোলাহলের কারণে কমেছে অতিথি পাখির আগমন। এমনটাই জানিয়েছেন এস্টেট শাখার (সম্পত্তি) ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমান। তিনি আরও বলেন, ‘লেকের পাড়ে যাতে কেউ উচ্চশব্দ সৃষ্টি না করে এবং সমাগম করে পাখিদের বিরক্ত না করে, সে জন্য লেকগুলোর পাড়ে স্থায়ীভাবে স্তম্ভ বানিয়ে সতর্কবার্তা লেখার এবং বেড়া দেওয়া হয়েছে । প্রো ভিসি ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ (শিক্ষা শাখা) স্যারের সাথে এ নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। জীববৈচিত্র্য ও পাখিদের রক্ষায় আমরা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি, আশা করছি খুব শীঘ্রই তার বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে।
লেক পরিষ্কার ও ইজারা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বছর লেকগুলো আমরা সময়মতো পরিষ্কার করেছিলাম। আর যে লেকগুলোতে পাখি বসে না, শুধু সেগুলোই ইজারা দেওয়া হয়।’
রবিউল হাসান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়