বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যতম সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে রাষ্ট্রই যেন সুপরিকল্পিতভাবে কিছু সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে রাখে। যেন সেটির এককেন্দ্রিকতা সবাইকে খুব ভালো করে ইমপ্যাক্ট করতে পারে।
এরকম একটা সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে আমরা দেখেছি শাসন ও শোষণ করা হয়। তাদের চিন্তা তাদের পদ্ধতি এবং তাদের সকল কিছুতে তাদের আধিপত্য দিয়ে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। ’
শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া একাডেমিক ভবনের প্রকৌশল অনুষদ গ্যালারিতে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ: শিক্ষা নিয়ে কিছু প্রস্তাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে শিক্ষাব্যবস্থাটা এটা একটা বড় একটা প্রতিষ্ঠান। এটাকে রাজনৈতিক ভাবেও দেখা হয় আবার অর্থনৈতিক ভাবেও দেখা হয়। এইটা উপনিবেশকাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রত্যেকটা সময়ই এই জিনিসটা হয়ে আসছে। রাষ্ট্র সবসময়ই শিক্ষাব্যবস্থা কে নিয়ে দুই-তিনটা কাজ করে থাকে। শিক্ষা হচ্ছে দখল করার বিশাল বড় একটা অস্ত্র। আমরা যেমনটা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখি ক্ষমতার পদ পরিবর্তন হওয়ার সাথে প্রতিষ্ঠান দখল হয়ে যায়। আর এই শিক্ষাটা হলো ইতিহাসের দখল করার প্রবণতা। প্রতিটা অভ্যুত্থান পরবর্তী একটা বয়ান সৃষ্টি হয়। যেমনটা আমরা দেখেছি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এক ইতিহাস, ৭১ গিয়ে আরেক ইতিহাস আবার ৭৫ এ গিয়ে আরেক বয়ান সৃষ্টি হয়ে যায়। এই ২৪ এ এসেও এই অভ্যুত্থান কে নিয়ে ৭ থেকে ১০ স্টেটমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। আর এই বয়ানগুলো কে প্রতিষ্ঠা করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইতিহাসের দখল নেওয়া। আর এই ইতিহাস দখলে নেওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হচ্ছে শিক্ষা কাঠামো। শিক্ষা কাঠামোতে থাকা মানুষগুলো এই বয়ানটাকে সাধারণের মধ্যে একটা দীর্ঘ মেয়াদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইঞ্জেক্ট করে দেয়।
তিনি আরও বলেন, এই শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে রাষ্ট্র মানুষের মগজ ও মন কেরে নিতে চায়। যখনই মন ও মগজ কিনে নিতে সম্ভব হয় তখনই শিক্ষিত দাশ স্বরুপ হয়। যেমনটা আমরা দেখেছি ২৪ এই অভ্যুত্থানের পর অনেক শিক্ষক পলাতক।
এছাড়াও আলোচনা সভায় জান্নাতুল ফেরদৌস রীতার সঞ্চালনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনক বক্তব্য রাখেন। এসময় বক্তারা অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামো নিয়ে আলোচনা ও কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এছাড়া শিক্ষা গবেষক ও লেখক রাখাল রাহা আলোচনার ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব তার বক্তব্যে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, ‘ভয় না পাওয়া, যেগুলো নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, তা নিয়ে প্রশ্ন করা এই ধরনের মানুষ তৈরি করা শিক্ষার একটা মূল উদ্দেশ্য। প্রত্যেকটা জিনিস জানতে চাওয়া, প্রত্যেকটা জিনিসের ব্যাখ্যা চাওয়া এবং যে সমস্ত জিনিসগুলো আমাদের আছে সেগুলোকে আরও একবার কাঠগড়ায় তোলা। সমালোচনা ছাড়া কোনো কিছুই আমাদের রাষ্ট্রীয় ও শিক্ষা জীবনে নেওয়ার আর কিছু নেই। প্রত্যেকটা জিনিসকেই নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। এটা যদি করা যায় তবে আমাদের যেটা দরকার যাতে আমাদের ভালো হবে, আমাদের ভেতরে কমিউনিটি সেন্স বাড়বে, বহুমতে বিভক্ত থেকেও একটা সিভিল উপায়ে সবাই সবার সাথে যে বিল্ড করার ক্ষমতা, সেটা অর্জন করতে পারব। মুখ বন্ধ রেখে এটা অর্জিত হবে না, এটাই আমাদের শিক্ষা।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন বলেন, ‘মিশেল ফুকোর “ডিসিপিল এন্ড পানিশ: দ্যা বার্থ অব দ্যা প্রিজন” বইয়ে আমরা দেখতে পাই, আমার কিছু নিরীহ, বিনিত ও অনুগত মানুষ দরকার। এই মানুষ বানাতে মানুষদের জেলখানায় পাঠানো হবে এবং জেল থেকে বের হওয়া মানুষ সমাজের সবচেয়ে উৎপাদনশীল মানুষ হবে। ১৬ শতকে ইউরোপে এই জেলের মডেলে স্কুলগুলো ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্র তার উৎপাদনশীল শ্রমিক তৈরি করতে স্কুল গড়েছে। শিক্ষার যদি আদর্শগতভাবে দেখি তাহলে চিন্তার জায়গা থেকে শিক্ষাকে একটু অন্যভাবে দেখা দরকার।’
ধারণাপত্র উপস্থাপন করে শিক্ষা গবেষক ও লেখক রাখাল রাহা বলেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার আজ এক অতি মুমূর্ষু দশা। বাংলাদেশের শিক্ষার ঘুরে দাঁড়ানো অথবা মৃত্যুর দিকে আরো এগিয়ে যাওয়া। তাই শিক্ষা নিয়ে কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর বা দলের বা সংগঠনের যে ভাবনাই থাক, বা সামষ্টিকভাবে যে উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথমে এই দিকটি ভাবতে হবে। দেশে চলমান শিক্ষা ব্যাবস্থায় অনেকগুলো ধারা, উপধারা ও মাধ্যম রয়েছে যেখানে দেশের প্রায় ৩ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। যে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের শিক্ষায় এইসব ধারার উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে তাকে স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে রেখে শিক্ষা উন্নয়নের কথা ভাবা যায়, আবার তাদের একত্রিত করেও ভাবা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মতো রাষ্ট্রের শিক্ষা-পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য নির্মাণে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তির বিচিত্র ইচ্ছা ও ইশারা থাকে। তাদের হয়ে এনজিও এবং আইএনজিও নামের নানা ধরণের উন্নয়ন-বাণিজ্যিক সংগঠন কাজ করে। এসব দেশের সরকার সেগুলো মেনে নিয়েই চলে, কারণ এতেই তাদের ক্ষমতাস্বার্থ রক্ষিত হয় তুলনামূলকভাবে অধিক। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বহুবিধ হীনস্বার্থ চরিতার্থের জন্য তারা নিজেরাও শিক্ষা-পরিস্থিতির মধ্যে পরিকল্পিতভাবে হস্তক্ষেপ করে।’
আলোচনায় বিভিন্ন বিভাগ ও ইন্সটিটিউটের শিক্ষকসহ দুই শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
দীন//বিএন