বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণপিটুনির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জনমনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনায় কখনও কর্মী-সমর্থক সন্দেহে, কখনও ধর্ম অবমাননার অভিযোগে, আবার কখনও চুরির সন্দেহে মানুষকে গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছে, যার ফলে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। মানবাধিকার কর্মীরা দাবি করছেন, পুলিশের অব্যবস্থা এবং তদন্তে ঘাটতির কারণে এই গণপিটুনিগুলো থামানো যাচ্ছে না।
পুলিশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা প্রতিটি ঘটনার গুরুত্ব সহকারে বিচার করবে। তবে বাংলাদেশে কাউকে সন্দেহের বশে অপরাধী বলে গণমতের সৃষ্টি করা এবং পরে গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যা করা নতুন কোনো বিষয় নয়।
সর্বশেষ বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে একজনকে গণপিটুনির শিকার হতে হয়। তাকে আটকের পর মারধর করা হয় এবং পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। একই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদও গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যান।
এর আগে ৭ই সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদও গণপিটুনিতে নিহত হন। যদিও এসব ঘটনায় মামলা দায়ের হয়, কিন্তু পুলিশ কার্যকর তদন্তের ক্ষেত্রে তেমন তৎপরতা দেখায় না, ফলে বিচার প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে বাড্ডায় তাসলিমা বেগম রেণুকে গণপিটুনির ঘটনায় মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।
মানবাধিকার আইন স্বীকৃত হলেও, বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থায় গণপিটুনির ক্ষেত্রে শাস্তি দেওয়া বিরল। বুধবার রাতে তোফাজ্জলকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাত সাড়ে আটটা থেকে তাকে মারধর করতে থাকে। পরে তার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন এবং ক্যাম্পাসে চলাফেরা করতে গিয়ে এই পরিস্থিতিতে পড়েন।
অন্যদিকে, শামীম আহমেদকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মারধর করে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে।
গণপিটুনিতে আহত অবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বলছেন, “স্ত্রীর জন্য ওষুধ নিতে এসেছিলাম ভাই। আমি ছাত্রলীগ করতাম বলেই ধরেছে। আমার পা ২০১৪ সালে কেটেছে। আমি তো অনেক দিন আগে থেকেই ছাত্রলীগ করা বাদ দিয়েছি।”
গত ৭ই আগস্ট রাতে রাজশাহী বিনোদপুর বাজারে ওষুধ কিনতে যাওয়ার সময় তিনি গণপিটুনির শিকার হন। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে মতিহার থানায় এবং পরে বোয়ালিয়া থানায় পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। বোয়ালিয়া থানার মেঝেতে শুয়ে থাকা অবস্থায় তার এই ভিডিও প্রকাশিত হয়। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মাসুদ মাত্র পাঁচ দিন আগে কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছিলেন।
দশ বছর আগে একটি হামলায় তিনি পা হারান। ২০১৪ সালের ২৯শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা তার ডান পায়ের গোড়ালি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং বাম পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার হাতের রগও কেটে দেওয়া হয়।
গুজব এবং জনমনে ক্ষোভের কারণে গণপিটুনি দেওয়া হত্যার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। ৫ই আগস্টের পর বিভিন্ন স্থানে ২১ জন গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হন, এবং আহত হন আরও অনেকে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে অন্তত ২৮৬ জন নিহত হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনায় মামলা হলেও শাস্তি প্রাপ্তির হার অত্যন্ত কম।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনর্গঠন না হওয়ায় দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ নিচ্ছে। তিনি বলেন, “গত ১৫/১৬ বছর ধরে মানুষ স্বৈরাচারী শাসনের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছে, যার ফলে জনমনে ক্ষোভ জমা হয়েছে।” এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে অপরাধী এবং নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিককে আইনের আওতায় বিচার লাভের অধিকার দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইন অনুযায়ী অপরাধীকে ধরার পর তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা বাধ্যতামূলক।
গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা আইনের আওতায় সমানভাবে দায়ী হবেন। গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারায় সবাইকে দায়ী করা হবে। আদালতে প্রমাণিত হলে সকলের শাস্তি নিশ্চিত হবে। গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সুতরাং, আইন অনুযায়ী গণপিটুনিতে হত্যার দায়ে অভিযুক্তদের ন্যূনতম শাস্তি ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ নিশ্চিত করা সম্ভব।