জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
নানা আয়োজনে পুরান ঢাকার জনপ্রিয় উৎসব সাকরাইন উদযাপন করা হয়েছে। মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ির সুতা দিয়ে অন্যের ঘুরি কাটা, বিল্ডিংয়ের ছাদে আতশবাজি ও ডিজে পার্টিতে মাতিয়েছে পুরান ঢাকাবাসী। তবে উড়ন্ত আগুন তথা ফানুস, ডিজে, লাউড স্পিকারে গান, আঁতশবাজি ও শব্দদূষণমুক্ত সাকরাইন চায় স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, নবাবপুর, শ্যামবাজার, ধূপখোলা, শাখারী বাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মী বাজার, ফরাশগঞ্জ, সদরঘাট, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা, নাজিরা বাজার, মুরগিটোলা ও ধোলাইখাল এলাকায় সাকরাইনের আমেজ। বিভিন্ন স্থানে ছোটবড় সবাই বিকালে ঘুরতে বের হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন এলাকার ছাদগুলোতে শুরু হয় আতশবাজি, ফানুস ওড়ানো ও ডিজে পার্টি।
শাঁখারি বাজারে দুই ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন মো. বাপ্পি নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা। পেশায় সরকারি চাকুরিজীবী। তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় ৩৭ বছর ধরে সাকরাইন উৎসব উদযাপন করছি। আজ আমার দুই ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছি। এদিন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ পুরান ঢাকায় আসে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব দেখতে।
তবে তিনি সাকরাইনে আতশবাজি, আগুনের খেলা, ফানুস ওড়ানো ও ডিজে পার্টি করাকে সমর্থন করেন না। আলাপকালে তিনি আরও বলেন, এগুলো আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়। ডিজে পার্টিতে হিন্দি গানে বাঙালির সংস্কৃতি ধূলিসাৎ হয়েছে। মাঝেমধ্যে ফানুসের আগুনে অগ্নিদুর্ঘটনাও ঘটে থাকে।
সাকরাইন উৎসবের ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ‘সাকরাইন’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ সংক্ৰাণ থেকে এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ হলো ‘বিশেষ মুহূর্ত’। অর্থাৎ বিশেষ মুহূর্তকে সামনে রেখে যে উৎসব পালিত হয় তাকেই বলা হয়
সাকরাইন। এই সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেক দেশেই এই উৎসব পালন করে। তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে। বাংলায় দিনটি পৌষ সংক্রান্তি এবং ভারতীয় উপমহাদেশে মকর সংক্রান্তি নামে পরিচিত।
ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, ১৭৪০ সালের এই দিনে মোঘল আমলে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি উড়ানো হয়। সেই থেকে এই দিনটি কেন্দ্র করে বর্তমানে এটি একটি অন্যতম উৎসব ও আমেজের পরিণত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ না রেখে সকলে এই উৎসব পালন করে থাকেন। দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করেন পুরান ঢাকাইয়ারা।
পুরান ঢাকার নবাবপুরের স্থায়ী বাসিন্দা নওশের আলী বলেন, ‘উড়ন্ত আগুন তথা ফানুস, ডিজে, লাউড স্পিকারে গান ও আঁতশবাজি সাকরাইনের ঐতিহ্য নয়। আমরা একটি শব্দদূষণমুক্ত সাকরাইন চাই।’
পুরান ঢাকার বাবুবাজার-আরমানিটোলা সমাজ কল্যাণ সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উড়িয়ে সাকরাইন উৎসব পালন করা ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ। এর মধ্যে ফানুস উড়ানোর কারণে অনেক সময় অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে মুহূর্তেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হতে পারে। এজন্য ফানুস উড়ানো ও আঁতশবাজি নিষিদ্ধ করা উচিত। এ ছাড়া অপসংস্কৃতির চর্চাও উদ্বেগজনক।’
এছাড়া এ বিষয়ে পুরান ঢাকার বাসিন্দা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. রাইসুল ইসলাম বলেন, আসলে আমরা বাঙালিরা সব বিষয়কে তেতো না বানানো পর্যন্ত হাল ছাড়ি না। সাকরাইনের বিষয়টিও এর বাইরে নয়। মূলত পুরান ঢাকার নারিন্দা, লক্ষ্মীবাজার, ফরিদাবাদ, ফরাশগঞ্জ, সূত্রাপুর, শাঁখারিবাজার, ডালপট্টি সহ আরো এলাকার গলি গলিতে বাড়িতে বাড়িতে এই উৎসব পালন করে। রাতে ডিজে লাইট ও উচ্চস্বরে গান এলাকার শব্দ দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যা আশেপাশের লোকজন এর ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করে।
এছাড়া অনুষ্ঠান উদযাপনে অন্যের যাতে কোনও সমস্যা না হয়, বাড়াবাড়ির পর্যায়ে না যায় – এ বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
মো. জুনায়েত শেখ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি