ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর বিজয় মিছিল থেকে একদল হামলাকারী গাইবান্ধা শহরের শতবর্ষী পাবলিক লাইব্রেরিতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর-লুটপাট করে। এ সময় লাইব্রেরির দুষ্প্রাপ্য বই, আসবাবপত্র, টিভি, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায় তারা।
৫ অগাস্ট বিকালের ওই মিছিল থেকে কারা এই হামলা চালিয়েছে তা নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। তবে পাঠাগার কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে সম্প্রতি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে।
লুট হওয়া দুষ্প্রাপ্য এসব বই ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য গাইবান্ধাবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জেলার বিশিষ্ট নাগরিক, গবেষক, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
পরে ১৯৩৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম স্পিকার গাইবান্ধার কৃতি সন্তান শাহ আব্দুল হামিদ, পৌরসভার চেয়ারম্যান দেবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সমাজকর্মী আব্দুল আওয়াল খাঁ, শাখাওয়াত হোসেন খান ছকু মিয়া, বীরেন্দ্র ভট্টাচার্য ডিবি রোডের পৌর পার্কের বর্তমানের জায়গায় লাইব্রেরিটি স্থানান্তর করেন।
ওই বছরই লাইব্রেরির আধা পাকা টিনসেড ভবনটি নির্মাণ করা হয়। সবার কাছে এটি ‘গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড ক্লাব’ নামেই বেশি পরিচিত। লাইব্রেরিতে ১১৭ বছরে প্রায় ২০ হাজার বইয়ের সংগ্রহ গড়ে ওঠেছিল। দুষ্প্রাপ্য বইয়ে ভরপুর এই গণপাঠাগারটির অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক জনি বলেন, “এই লাইব্রেরি সবার,এখানে সব দলের, সব মতের মানুষের যাতায়াত। এ ছাড়া লাইব্রেরির মিলনায়তনে সব রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের অনুষ্ঠান, কর্মশালা ও আলোচনা সভা করে। সেই লাইব্রেরিতে লুটপাট-ভাঙচুর করবে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
ঘটনার সময় নিজে বাসায় ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “মধু মিয়া ও দেলোয়ার হোসেন নামে দুই নিরাপত্তা প্রহরী লাইব্রেরিতে ছিলেন। বিজয় মিছিল থেকে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র হাতে একদল হামলাকারী এসে লাইব্রেরিতে হামলা চালায়। এ সময় বাধা দিলে তারা মধু মিয়া ও দেলোয়ার হোসেনকে মারধর করে। তারা দরজা ভেঙে লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদকের কক্ষ, মিলনায়তন ও পাঠাগার- এই তিনটি কক্ষ ভাঙচুর ও লুটপাট করে।”
মিলনায়তন কক্ষ থেকে ৫৬ ইঞ্চি ও ৩২ ইঞ্চি দুটি টিভি, ডিজিটাল ঘড়ি, মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সার্ভিস, স্টেজ চেয়ার, সোফা, এলইডি বাল্ব এবং ১৩৫টি প্লাস্টিক চেয়ার লুট করে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া সাধারণ সম্পাদকের কক্ষ থেকে জিএফসি স্ট্যান্ডফ্যান একটি, ৩২ ইঞ্চি টিভি একটি, একটি কম্পিউটারের পূর্ণাঙ্গ সেট, কাঠের গদির চেয়ার, দেয়াল ঘড়ি, কাঠের হাতাওয়ালা ও হাতাছাড়া চেয়ার লুট করে।
অপরদিকে লাইব্রেরি থেকে বইয়ের আলমারির গ্লাস ভেঙে দুষ্প্রাপ্য বইসহ আনুমানিক ছয় হাজার বই, আইপিএস মেশিন ও ব্যাটারি, দেয়াল ঘড়ি লুট করে নিয়ে যায়।
গাইবান্ধার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক মাজহার-উল-মান্নান বলেন, “গাইবান্ধার শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী পাবলিক লাইব্রেরির আসবাবপত্রসহ বহু মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য বই লুট হয়ে গেছে। আসবাবপত্র হয়তো পুনরায় সংগ্রহ করা যাবে কিন্তু দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থগুলোর কী হবে? যারা এগুলো নিয়ে গেছেন তাদের হয়তো তেমন কোনো কাজেই আসবে না।”
তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, “বইগুলো লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের হাতে ফেরত দিয়ে নিজেদের বিবেকের দায় থেকে মুক্ত হন। মন পরিষ্কার হবে, শান্তি পাবেন।”
তবে, এমন আহ্বানের পর এখনো কোনো বই ফেরত আসেনি।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জেলা সংসদের সভাপতি অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম বলেন, “বুঝে বা না বুঝে যারাই বইগুলো নিয়ে গেছেন, তাদের বইগুলো ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। এতে পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হবে।”
গাইবান্ধা সদর থানার ওসি মাসুদ রানা জানান, এ ঘটনায় ১২ অগাস্ট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে। পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।