রুশাইদ আহমেদ: বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় নতুন নতুন সমস্যা জন্ম নেওয়ার বিপরীতে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সেই সমস্যার সমাধানও খুঁজে নিচ্ছে মানুষ। ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের দরকার পড়ছে জটিল চিন্তন দক্ষতা বা ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিংয়ের মাধ্যমে সৃজনশীলতার সঙ্গে বহুবিধ সমস্যার সমাধান উদ্ভাবনের।
আর এই ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছে, তা হলো ব্রেইনস্টর্মিং।
শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র বা নীতিনির্ধারণী সভা—সবখানেই প্রয়োজন সৃজনশীল চিন্তার। আর এই সৃজনশীলতার মূল চালিকাশক্তিই হলো ‘ব্রেইনস্টর্মিং’। এটি শুধু ধারণা উদ্ভাবনের একটি কৌশল নয়, বরং দলগতভাবে চিন্তা ভাগাভাগির একটি প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যক্তির চিন্তা দলীয় ভাবনায় রূপ নেয়।
পেশাগত পরিসরে ব্রেইনস্টর্মিং
কর্পোরেট দুনিয়ায় প্রতিযোগিতা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। একটি প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা এখন নির্ভর করে তার উদ্ভাবনী শক্তি ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ওপর। ব্রেইনস্টর্মিং সেই সক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলে নব উদ্যমে। এটি কর্মীদের নির্দ্বিধায় নতুন চিন্তা উপস্থাপন করতে উৎসাহিত করে।
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা কর্মীদের সম্মিলিত ব্রেইনস্টর্মিং সেশন একটি সমন্বিত ও বাস্তবসম্মত সমাধান বের করে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এটি একজন ব্যক্তির পক্ষে এককভাবে ভাবা কখনো সম্ভব; আবার সম্ভব হয় না।
তা ছাড়া, ব্রেইনস্টর্মিং কর্মপরিবেশে অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতি গড়ে তুলতেও সহায়তা করে। এটি কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের যৌথ মালিকানাবোধের সৃষ্টি করে। ব্রেইনস্টর্মিং করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কর্মীরা যখন দেখেন তাদের মতামত গুরুত্ব পাচ্ছে, তখন তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের অংশ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। এবং আরও কার্যকরভাবে ব্রেইনস্টর্মিং করার প্রেরণা পায়।
শিক্ষাক্ষেত্রে ব্রেইনস্টর্মিংয়ের ভূমিকা
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুধু তথ্য দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জ্ঞানকে বিশ্লেষণ, প্রয়োগ ও নতুন রূপে গড়ার সক্ষমতাও তৈরি করতে হয় শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে।
সেই আঙ্গিক হতে ব্রেইনস্টর্মিং শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ঘরানার স্বতন্ত্র চিন্তার স্বাধীনতা গড়ে তোলে। এতে শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি একে অন্যের অভিজ্ঞতার আলোকে পড়াশোনার বিষয়াদি আরও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে শেখে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণাকর্ম, প্রজেক্ট তৈরি কিংবা ক্লাসরুম ডিসকাশনে ব্রেইনস্টর্মিং কার্যকর ভূমিকা রাখে। এটি শুধু শিক্ষার্থীর চিন্তার বিস্তার ঘটায় না, বরং দলীয় কাজে নেতৃত্ব ও সহযোগিতার গুণও গড়ে তোলে।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ব্রেইনস্টর্মিংয়ের গুরুত্ব
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বা নীতি তৈরির প্রক্রিয়ায় এখন আগের মতো আর একক সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে উঠছে না। কেননা আজকের দুনিয়ায় নীতিনির্ধারণ ক্ষেত্রে বহু স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তর, অংশীজন, গবেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে ব্রেইনস্টর্মিং সেশন আয়োজন একটি ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিনির্ধারণের পথের জন্ম দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কোনো একটি দেশের নীতিনির্ধারণ যদি শুধু অর্থনীতিবিদ দিয়ে হলে পরিবেশবিদ, কৃষিবিদ বা স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা সেখানে বাদ পড়ে যায়। ব্রেইনস্টর্মিং সেই ফাঁকটা পূরণেই কাজ করে।
ব্রেইনস্টর্মিংয়ের সফল প্রয়োগে যেসব বিষয় মাথায় রাখা জরুরি
১. সবাইকে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার স্বার্থে ক্ষমতা ও অবস্থাননিরপেক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
২. সমালোচনা এড়িয়ে ভাবনার উৎসাহ জোগানোও ব্রেইনস্টর্মিংয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ যোগ করে। কোনো আইডিয়াকে শুরুতেই খারিজ না করে পর্যালোচনার সুযোগ দিতে হবে।
৩. বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানানোর মাধ্যমেও ব্রেইনস্টর্মিং প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। কেননা ভিন্নমতের চিন্তাকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি। তাতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়।
৪. ব্রেইনস্টার্মিংয়ের সময় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো ডকুমেন্টেশন ও মূল্যায়ন করা জরুরি। সেশন শেষে ভাবনাগুলো লিপিবদ্ধ করে সেগুলোর সম্ভাব্যতা বিচার করার ফলে সঠিক নীতিনির্ধারণ সম্ভব হয়ে ওঠে।
অল্পকথায়, ব্রেইনস্টর্মিং কেবল একটি কৌশল নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক অনুশীলন। এটি আমাদের চিন্তা করতে শেখায়, সহযোগিতা করতে শেখায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব বোঝায়।
তাই পেশা, শিক্ষা ও নীতিনির্ধারণ—এই তিন পরিসরেই ব্রেইনস্টর্মিংয়ের চর্চা আমাদের ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত করে তোলে। যেখানে প্রতিটি চিন্তাই হতে পারে পরিবর্তনের বীজ।


