সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার এবং ২০১৮ সালের জারিকৃত পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে গত ১ জুলাই থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। একইসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত হয় সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কর্মবিরতি।
পরে মধ্য জুলাইয়ে সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা বিস্তৃত হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেয়। স্থগিত করা হয় চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাও। ফলে থমকে দাঁড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র দেশের শিক্ষাব্যবস্থা।
এরই সূত্র ধরে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতন ঘটে। তিনদিন পর ৮ আগস্ট নতুন করে শপথ নেয় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ২২ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে এর আগে গত ৬ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশ দিলেও তখনকার অরাজক পরিবেশে গুটিকয়েক স্কুল-কলেজ ব্যতীত কোথাও সেভাবে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
উপরন্তু, সরকার পতনের পরপরই দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা শুরু করেন গণপদত্যাগ। একে একে ইস্তফা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় ২০টিরও বেশি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অধিকাংশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তা ছাড়া, যে সকল কর্মকর্তা এখন অবধি স্ব স্ব পদে বহাল রয়েছেন, তাদের পক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শতভাগ প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব নয়।
এ অবস্থাতেই গত ১৮ আগস্ট পুরোদমে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশনা দেওয়া হলেও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্ব স্ব সিন্ডিকেট সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করতে বলা হয়। অথচ বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একরকম প্রশাসনশূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। যদিও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু বিভাগে পাঠদান কার্যক্রম বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয়েছে, তবে তাকে ‘পুরোদমে’ বলে উল্লেখ করার কোনো সুযোগ নেই।
আবার কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর প্রজ্ঞাপন জারি করে সংশ্লিষ্টরা পদত্যাগ করলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীলরা সেটাও করেননি। তা ছাড়া, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং আবাসিক হলসমূহের প্রভোস্ট ও সহকারী প্রভোস্টরা দায়িত্বে না থাকায় আবাসিক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এমতাবস্থায় শিক্ষাবর্ষের আরও অযথা দীর্ঘায়ন রোধকল্পে প্রশাসনিকভাবে শূন্যতায় ভোগা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে সত্বর নজর দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রশাসনশূন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণগুলোতে বর্তমানে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তেমনি অধিকাংশ শিক্ষকও নিয়মিতভাবে ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আবার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলপ্রকাশের প্রক্রিয়া থমকে গিয়েছে সে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ডিন কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পদত্যাগ করায়। এতে করে ওইসব শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় আবেদন করার সুযোগ হারাচ্ছেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রশাসনিক শূন্যতা দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গণগুলোকে বেশ বড় একটা সেশনজটে পড়ার শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় চাকরিতে প্রবেশের কম বয়সসীমাবিশিষ্ট একটি দেশের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীদের ওপর সৃষ্টি করেছে তুমুল মানসিক ও পারিবারিক চাপ— বিশেষত যখন তাদের অধিকাংশেরই আগমন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে।
ফলে এ পরিস্থিতিতে দেশের উপাচার্যবিহীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্বর উপাচার্য নিয়োগে পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নীতিনির্ধারণী সিন্ডিকেট, সিনেট কিংবা অন্যান্য কমিটির সভাগুলো আহ্বান করার এখতিয়ার শুধু উপাচার্যদেরই থাকে। পাশাপাশি, উপাচার্যরাই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিষয়ক কমিটির প্রধান তথা প্রধান একাডেমিক ও প্রশাসনিক নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সার্বিকভাবে বলা যায়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকের ভূমিকায় থাকেন উপাচার্য। তাই উপাচার্যশূন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্রুত যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে।
এ ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশ রোধ করাসহ শিক্ষার্থীদের সকল ধরনের উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টররা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন সার্বিকভাবে। পাশাপাশি, হল প্রভোস্টরা দেখভাল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর সার্বিক নিরাপত্তার দিকগুলো। সঙ্গে সঙ্গে হলের আসন বরাদ্দসহ অন্যান্য সমস্যা সুরাহার বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে হলসমূহে শৃঙ্খলা বজায় রাখাও তাঁদের দায়িত্ব। তাই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রক্টর ও আবাসিক হলসমূহের প্রভোস্টদের শূন্য হওয়া পদগুলোও যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করা দরকার ক্যাম্পাসগুলোতে সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে।
আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন ট্রেজারাররা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা খাতে বিনিয়োগ এবং বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা হচ্ছে কি-না তা খতিয়ে দেখেন। অধিকন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অর্থনৈতিক নানা চুক্তিও সম্পাদন করে থাকেন ট্রেজারাররা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আর্থিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারারের পদ শূন্য হয়ে গেছে তা সত্বর পূরণ করা অতীব জরুরি।
পাশাপাশি, রেজিস্ট্রাররাও সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর প্রশাসনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক কর্মকর্তা হিসেবে সিনেট, সিন্ডিকেট এবং একাডেমিক কাউন্সিলের সচিবের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল রেকর্ড, দলিল, সাধারণ দাপ্তরিক সিলমোহর, উপাচার্য কর্তৃক প্রদত্ত গোপন প্রতিবেদন এবং গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রারসমূহ রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দাপ্তরিক পত্র আদান-প্রদান এবং অর্থ সংশ্লিষ্ট চুক্তি ব্যতীত সকল চুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্বও রেজিস্ট্রারদের। ফলে যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রাররা এখন আর পদে বহাল নেই; তাঁদের স্থলে নতুনদের নিয়োগের মাধ্যমে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনকে সক্রিয়করণের উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
গত জুলাইয়ে আন্দোলন শুরুর পর থেকে ইতিমধ্যে দেড় মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ১৮ আগস্ট থেকে পুরোদমে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশনা দিয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ শিক্ষাঙ্গণগুলোতে প্রশাসনিক শূন্যতায় এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে পাঠদান, পরীক্ষাগ্রহণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কার্যক্রম এখনও শুরু করা যায়নি। এমতাবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনসহ (ইউজিসি) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক শূন্যতা দূরীকরণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে শিক্ষাবর্ষের আরও অযথা দীর্ঘায়ন রোধে ভূমিকা রাখবে— এটাই সকল সাধারণ শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের প্রত্যাশা।
[লেখক: শিক্ষার্থী,
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।]
আরএস//