বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ শাহজাহান ওমর। ১৯৭৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিএনপি যে কয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে ২০০৮ বাদে সব কয়টি নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থী হয়েছেন তিনি। দলের মনোনয়ন নিয়ে পাঁচবার সংদস সদস্য ও একবার মন্ত্রী হয়েছেন। সবশেষ কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন মোহাম্মদ শাহ জাহান ওমর।
কিন্তু হঠাৎ বৃহস্পতিবার বিকেলে পাল্টে যায় সব কিছু। হঠাৎ করে দল পাল্টে আওয়ামী লীগে যোগদান করায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু পরিণত হয়েছেন তিনি। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছর বিএনপির রাজনীতি করার পর আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় বিভ্রান্তিতে পড়েছে ঝালকাঠির স্থানীয় বিএনপি। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ গত রোববার সারা দেশে দল মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে। তখন রাজাপুর-কাঁঠালিয়া নিয়ে গঠিত ঝালকাঠি-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বর্তমান সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনের নাম ঘোষণা করা হয়। সেখানে হঠাৎ বিএনপির এক নেতার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার খবর বিস্ময় তৈরি করেছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। শাহজাহান ওমর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কাওরান বাজারের ইউটিসি ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে নৌকার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে আনেন। এরপর থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এরপরই তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
আওয়ামীলীগে যোগ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সদ্য বহিষ্কৃত ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর বলেছেন, ‘জিয়ার রাজনীতি ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে আসা, আমি তো মনে করি এটা প্রমোশন।’ শাহজাহান ওমর আরো বলেন, ‘স্বতন্ত্র বলতে কি কোনো জিনিস আছে নাকি? স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচনে অংশ নেব কেন, যখন বেটার অপশন আছে!!’বি গ্রেডেড হব কেন? নাচতে নামছি যখন, ঘোমটা দিলে হবে নাকি।’‘রাজনীতিতে মার্কা ছাড়া নির্বাচন হয় না, মার্কা তো লাগবেই।’
২০০৩ সালে জোট সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে শাহজাহান ওমর নিজের কিছু জমি ও সড়কের পাশে রাস্তা ও মহাসড়কের কিছু জমির ওপর বিশাল আকৃতির দোতলা ভবন তৈরি করে বিএনপি অফিস নির্মাণ করেন। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালে সেনাবাহিনী সরকারি জমির ওপর তৈরি করা অংশ ভেঙে ফেলতে চাইলেও কোনো শ্রমিক ওমরের ভবন ভাঙার কাজে রাজি হয়নি। তিনি দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন এখানে বসেই। এখানটা নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর থাকত। বিএনপির নেতাকর্মীদের ফেস্টুন-পোস্টারে সাজানো ছিল ভবনটি।শাহজাহান ওমর আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাজাপুরে তার বাসভবনের কেয়ারটেকার ইদ্রিস বাইপাস মোড়ে বিএনপি অফিস থেকে সাইনবোর্ড খুলে ফেলেছে এবং আসবাবপত্র ফেলে দিয়েছে। বিএনপি নেতারা একদিন সময় চেয়েছিলো আসবাবপত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো সময় দেওয়া হয়নি। বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করছেন, এই কার্যালয় এখন শাহজাহান ওমরের নির্বাচনী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
শাহজাহান ওমরের এভাবে দল পাল্টানো মেনে নিতে পারছেন না স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। রাজাপুর উপজেলা বিএনপি নেতা্রা শাহজাহান ওমরের নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার তারা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তারা জানিয়েছেন, বিএনপির স্বার্থে কাজ না করে শাহজাহান ওমর নিজের আখের গুছিয়েছেন।
শাহজাহান ওমরের নৌকা নেওয়ার ঘটনায় রাজাপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নাসিম আকন সংবাদ সম্মেলন করে তীব্র প্রতিবাদ জানান।
এ বিষয়ে ঝালকাঠি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো: রফিকুল ইসলাম জামাল বলেন, দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা দলের শত্রু আজ চিহ্নিত হয়েছে। দলের সাথে বেইমানি করায় নেতাকর্মীরা তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছে। তিনি আরো বলেন, ঝালকাঠি জেলা বিএনপিসহ কেন্দ্রীয় বিএনপি আজ জঞ্জাল মুক্ত হয়েছে। শাহজাহান ওমর দলের জন্য কখনোই কাজ করেননি। ব্যক্তি সুবিধা পেতে দলে ছিলেন। ইতোমধ্যে তাকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। আমরা ঝালকাঠি জেলা বিএনপি তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছি।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির আরেক সদস্য অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান মুবিন বলেন, দলের নেতাকর্মীদের আবেগ অনুভূতিতে আঘাত করেছেন তিনি। ১৫ বছর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে লড়াই সংগ্রামে দমন-পীড়নকারীদের নৌকার মাঝি হওয়ায় সব শ্রদ্ধা সম্মান বিসর্জিত হয়েছে।
ঝালকাঠি-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করায় ব্যারিস্টার মেজর (অব.) শাহজাহান ওমরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে জেলা বিএনপি। শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) সকালে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট শাহাদাত হোসেন এক ভিডিও বার্তায় এ ঘোষণা দেন।
এদিকে শাহজাহান ওমরকে মনোনয়ন দেওয়ায় ক্ষোভ ঝেড়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান সাইফুল্লাহ পনির। তিনি বলেন শাহজাহান ওমরের নৌকার প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার বিষয়ে কেন্দ্র থেকে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা নেই। এ আসনে এখন পর্যন্ত বজলুল হক হারুন নৌকার মনোনীত প্রার্থী।
আওয়ামী লীগের আরেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুজ্জামান বলেন, শাহজাহান ওমরকে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরা মেনে নেবেন না। তাকে রাজাপুর ও কাঁঠালিয়ার জনগণ প্রত্যাখ্যান করবেন।
ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের হাতে একসময় লাঞ্ছিত হওয়ার কথা জানিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, হঠাৎ প্রার্থী পরিবর্তন হওয়াটা দলের নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারছেন না। তবে এখন দল যে সিদ্ধান্ত দেবে সে অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য আমরা।
তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পাওয়া বর্তমান সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এর বাইরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. মনিরুজ্জামান এ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
তৃণমূল বিএনপির পক্ষে এখানে প্রার্থী হয়েছেন জসীম উদ্দীন তালুকদার। এ ছাড়াও সদ্য বহিষ্কৃত বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার আবুল কাশেম ফখরুল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
ঝালকাঠি-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুন ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর, জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো: এজাজুল হক, স্বতন্ত্র প্রার্থী এম মনিরুজ্জামান মনিরসহ মোট ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।
সব মিলিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে ঝালকাঠি-১ আসন।