মঙ্গল কামনায় প্রতি বছরের ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় নওগাঁয় নানান আয়োজনে দুইদিন ব্যাপী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কারাম বৃক্ষের ডাল পূজাকে কেন্দ্র করে কারাম উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দেওয়ানপুর আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলার আয়োজন করেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তরুণ-তরুণীরা রঙিন সাজে সজ্জিত হয়ে বাদ্যের তালে নেচে গেয়ে উদ্যাপন করে কারাম উৎসব।
অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তরুণ-তরুণীদের নাচ ও গান উপভোগ করেন হাজারো মানুষ। মিলন মেলায় পরিণত হয় দেওয়ানপুর স্কুল মাঠ।
সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব কারাম। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় প্রতি বছর এ উৎসবের আয়োজন করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আদবাসীরা। অধ্যুষিত গ্রামে গ্রামে কারাম বৃক্ষের ডাল পূজাকে কেন্দ্র করে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। তাঁদের বিশ্বাস এটি অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্যলাভের উৎসব। ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনের কামনা-বাসনা পূরণের লক্ষ্যে প্রার্থনা করে থাকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। এই পূজাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ দিন ধরে নওগাঁর বিভিন্ন অঞ্চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আদিবাসী সম্মেলনের আয়োজন হয়ে আসছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই দুই দিনব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিন গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে উপজেলার হাতুড় ইউনিয়নের দেওয়ানপুর বগাপাড়া, বাঁশপাড়া, পাহান পাড়া, কারামগোছা ও গোবরা পাড়া ও এর আশপাশের গ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নর-নারী বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করেন।
দিনভর উপোস থাকতে হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নর-নারীদের। সন্ধ্যার আগে অবিবাহিত যুবকদের উপর দায়িত্ব থাকে কারাম (খিল কদম) ডাল কেটে এনে পূজার বেদিতে বসানোর। এরপর সন্ধ্যার পর কারাম গাছের ডাল বেদিতে বসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় পূজা। এরপর রাতভর মূল আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেয় নারীরা।
তারা দিয়াবাতি, জাওয়া ডালি (অংকুরোদগম শস্য বীজের ডালি), লাল মোরগ, ফলমূলের ডালা বা থালা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে পূজার বেদিতে উৎসর্গ করেন। সেখানে পূজা পর্ব পরিচালনা করেন পুরোহিত মতিলাল পাহান। রাত একটু গভীর হলে শিশু, কিশোর-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সী নর-নারী গ্রামের পূজাস্থানে জড়ো হন। সেখানে পুরোহিত নবীন পাহান নতুন প্রজন্মের কাছে কিচ্ছা আকারে কার্মা ও ধার্মা দুই ভাইয়ের কাহিনী তুলে ধরার পর উপোস থাকা নারীরা পরস্পরকে খাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে উপোস ভাঙে এবং বেদীতে পুঁতে রাখা কারাম ডালের চারপাশ ঘুরে ঘুরে ঢাক-ঢোল ও মাদলের বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীরা।
রাতের পূজা পর্ব শেষে আজ বুধবার সকালে সবাই মিলে বিভিন্ন আচার শেষে গীত গাইতে গাইতে কারাম ডালকে সঙ্গে নিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে এবং গ্রামের পাশ দিয়ে বইয়ে যাওয়া আত্রাই নদীতে বিসর্জন দেন।
পূজা পর্ব শেষে বিকেলে দেওয়ানপুর আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যারয় মাঠে সাংস্কৃতিক মিলনমেলা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ মিলনমেলায় নওগাঁর মহাদেবপুর, পত্নীতলা, নিয়ামতপুর উপজেলা ছাড়াও জেলার অন্যান্য উপজেলা এবং বাইরের জেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক দলগুলো অংশ নেয়।
“৩২ টি সাংস্কৃতিক দল নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য তুলে ধরে ঢাক-ঢোল, মাদল ও করতালের (ঝুমকি) তালে তালে নাচ ও গান পরিবেশন করে। নাচে-গানে ও ঢোল-মাদলের আওয়াজে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে দেওয়ানপুর স্কুল মাঠ।”
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক মিলন মেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (আইএসসি) এর নির্বাহী পরিচালক অনিক আসাদ। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নরেন পাহান, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) নওগাঁ জেলা কমিটির সমন্বয়ক জয়নাল আবেদিন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইএসসির নির্বাহী পরিচালক অনিক আসাদ প্রমুখ।