রাত ৯টা বাজে। আমি ও মারুফ দুই বন্ধু মিলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরে সাদ্দাম ভাইয়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি আর এলাকার খোঁজ-খবর নিচ্ছি। মারুফ আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। সে রাজশাহীতে এসেছে ঘুরতে আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন ছাত্র। হঠাৎই খেয়াল করলাম ৬ থেকে ৭ বছরের একটা বাচ্চা ‘বাদাম বাদাম’ বলে ডাকছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে একটু দূরে চলে গিয়েছিল সে। তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই তাকে ডাক দিলাম যদিও আমার বাদাম খাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। প্রথমে বসতে না চাইলেও পরবর্তীতে আমার পাশেই বসলে জিজ্ঞেস করলাম নাম কী তোমার? বললো আমার নাম মুরসালিন। বাবার নাম বদিউল আলম (বদি)। পেশায় রিকশা চালক। মায়ের নাম মেরিনা আক্তার। ভাই-বোন সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বলে আমি সবার বড়। আমার ছোট্ট দুইটা বোন আর একটা ভাই আছে। জানতে চাইলাম তারা কী করে? প্রতিউত্তরে সে বলে দুই বোন আমার মতোই এখানে বাদাম বেচে (বিক্রি করে)। ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করাতে বলে, ভাইয়ের বয়স ৮ মাস।
বললাম মুরসালিন, লেখাপড়া করো? বলে, না। স্কুলে যেতে চাও? বলে, হুম আমার ইচ্ছা আমি স্কুলে যাবো। তাহলে কেন যাওনা? উত্তরটি শুনে আমি অনেকটাই অবাক হয়ে গেলাম। কারণ তার মা নাকি বলছে স্কুলে না যেতে।
জিজ্ঞেস করলাম যদি স্কুলে যেতে পারতে তাহলে লেখাপড়া করে বড় হয়ে কী হতে? সে বলে আমি মানুষ হতে চাই। তার ইচ্ছে কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা পুলিশ প্রশাসন নয়। তার একটাই ইচ্ছে সে মানুষ হতে চায়। তার এবং তার পরিবার সম্পর্কে জানতে তখন আমার ইচ্ছেটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
পরিবারের সঙ্গে কথা বলাটাও সহজ হয়ে গেল কারণ তার সাথে কথা বলতে বলতেই তার মা, খালা ও নানি উপস্থিত হন সেখানে। মুরসালিন এর কথা ঝেড়ে— তার মাকে বললাম আপনার কয় সন্তান। তিনি বললেন, দুই সন্তান। মুরসালিন আর মিনারুল। মিনারুল তার কোলেই ছিল। বললাম মুরসালিন তো বলল, তারা নাকি দুই ভাই দুই বোন। তিনি বললেন, অই (ওই) দুই বোন তার খালাতো বোন। আমি বললাম তারাও কি এখানে বাদাম বিক্রি করে? বললেন, হ্যাঁ। তাদেরকে নিতেই আমরা এখানে এসেছি।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, মুরসালিন বলল ওকে নাকি ভাড়ার টাকা না থাকার জন্য স্কুলে যেতে দেন না। তিনি বললেন, আমারও ইচ্ছে তাকে স্কুলে দেওয়ার কিন্তু তার বাবা মুরসালিন এর টিকা কার্ড ও জন্ম সনদ হারিয়ে ফেলেছে। তখন বললাম, এগুলো সংগ্রহ কেন করেন না? তিনি বলেন, আমি গিয়েছিলাম কিন্তু তারা বলে এসব করতে নাকি ৫০০০টাকা লাগবে। আর কোথায় কোথায় যেতে বলে আমি চিনিও না। মহিলা মানুষ তো কথি (কোথায়) আর যাবোই!
বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা চৌদ্দপাই থাকি।বললাম, ভাড়া থাকেন নাকি নিজের বাড়ি। মুচকি হেসে বলে নিজের বাড়ি নাই বাবা! ভাড়াই থাকি।
তার বাবার রিকশা কি নিজের নাকি ভাড়ায় চালিত? বললেন, নিজের। কিন্তু পরের কথাটা গল্পটাকে আরও গভীরে নিয়ে যায়। তিনি আরেকটা বিয়ে করছেন। ওইখানেই বেশিরভাগ সময় থাকে। ওইখানেও তার ছেলে মেয়ে আছে। জানতে চাইলাম, প্রথম স্ত্রী কে? তিনি জবান দিলেন, আমি দ্বিতীয় স্ত্রী। ওটা প্রথম স্ত্রী। আমি এক নাট্যদলের সঙ্গে কাজ করতাম এখন আর করা হয় না, কারণ এখন তাদের শুটিং নাই। এ দিকে মুরসালিন ও আমার কাছে টাকা চায়। ওর কাগজপত্র না থাকার কারণে মাদ্রাসায়ও দিতে পারিনা। তাই মুরসালিনকে বলি বাড়িতে না থেকে বাদাম বিক্রি কর।
গল্পটাকে আরেকটু বাড়িয়ে তুলে মুরসালিনের নানি। তিনি বলেন:
“আমার বাসা রাজশাহীর চারঘাট। আমরা থাকতাম বাগেরহাট জেলায়। সেখানে বন্যায় আমাদের বাড়িঘর তলিয়ে নিয়ে যায়। সেখানে থাকার মতো আর জায়গা নাই। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ ভবনের পাশে আমরা থাকতাম কিন্তু যখন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক (নির্মিত) হয় তখন আমাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। এখন ভাড়ায় অন্যের বাড়িতে থাকতে হয়। বাসা ভাড়া ৩০০০ টাকা হলেও বিদ্যুৎ বিল এসে যায় ১৫০০টাকা। কী করবো বাবা, কিছুই করার নেই। থাকতে তো হবেই!…”
মুরসালিন এর মা বলেন, “কষ্ট করি আর যা-ই করি বাঁচতে তো হবে। মরে যেতে তো পারব না।”
আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে কতই না টাকাওয়ালা রয়েছে, যারা আজ তার মনুষ্যত্ব বিলিয়ে জীবনধারণ করে। অনেকে আবার নিজেকে ভদ্র মানুষ দাবি করেও গরিবের উপর জুলুমে লিপ্ত। গরবদের মেরেই সে বড় হতে চায়। অনেকে আবার এই স্বপ্ন দেখে— সে বড় হয়ে বড্ড বড় একটা চাকরি নিবে। অনেক টাকার মালিক হবে। কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট মুরসালিন বাদাম বিক্রি করে। সাত বছর বয়সেই সে তার পরিবারের আয়ের উৎস। তার মাঝে কোনো অট্টালিকার চাহিদা নেই। নেই কোনো ভালো চাকরির চাহিদা। তার একটাই স্বপ্ন সে মানুষ হতে চায়। এমন মুরসালিন আছে বলেই তো আমাদের আশপাশটা এত সুন্দর। তারাই তো এই পৃথিবীর আসল ফুল। তাদেরকে ফুটতে দেওয়া উচিত। তারাই প্রকৃতির সুন্দরতম মানুষ!
দীন/আরএস