রাবি প্রতিনিধিঃ
বিশ্ব মা দিবস আজ। জন্মের পরে যার সঙ্গে সন্তানের সবচেয়ে বেশি মিতালি, সন্তানের সবচেয়ে বেশি আপন তিনি মা। সূর্যোদয়ের মতো নিশ্চিত, সন্ধ্যার মতো নির্মল মায়ের ভালোবাসা প্রকৃতির সেই অমোঘ সত্য, যা কোনো ব্যাকরণ বা যুক্তির ধার ধারে না। বার্ট্রান্ড রাসেল তার ‘ম্যারিজ অ্যান্ড মোরালস’ বইয়ে বলেছেন, মাতৃত্ব সহজাত প্রবৃত্তি, পিতৃত্ব সহজাত নয়।
জন্মদাত্রী মা, যার কল্যাণে পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখে সন্তান। সেই মায়ের স্মরণে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘বিশ্ব মা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রিস থেকে রোম, মাতৃউপাসনার ইতিহাস সুপ্রাচীন। কিন্তু আধুনিক মা দিবসের সূচনা হয় অ্যানা জারভিসের হাত ধরে, যে কন্যা মায়ের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে চেয়েছিলেন।
যদিও মাকে ভালোবাসা-শ্রদ্ধা জানাতে কোনো দিনক্ষণ লাগে না, তবুও মাকে গভীর মমতায় বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন আজ। মা দিবসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শিক্ষার্থীদের ভাবনা তুলে ধরেছেন বিডিএন৭১ এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি দীন ইসলাম ।
পৃথিবীর সকল ‘মা’ সন্তানের কাছে একজন ম্যাজিশিয়ান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব মল্লিক মা দিবসে তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, প্রতিদিনই আমরা নিজেদের প্রমান করার কাজে ব্যস্ত থাকি। আমরা যদি কাউকে আমাদের মন খারাপের কথা বলি তবে সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রমাণ করতে হয়। বন্ধুকে যদি বলি আমার মন খারাপ তাহলে বন্ধু বলে ‘প্লিজ, ঢং ধরিস না।’ কিন্তু মা এমন মানুষ, যার কাছে আমাদের প্রমান না করলেও চলে, বরং আমরা আমাদের মনের কষ্ট, দুঃখ আড়ালে রেখে তার সামনে হাসিমুখে থাকার চেষ্টা করলেও সে বুঝে ফেলে সন্তানের মন খারাপ।
তিনি বলেন, পৃথিবীর সকল ‘মা’ হলেন তাদের সন্তানের কাছে এক একজন ম্যাজিশিয়ান। মা নিষেধ করেছে এমন কাজ প্রচুর করেছি। তবে কখনোই সে কাজে আমি ভালো ফল পাইনি। বরং মায়ের নিষেধ করা কাজ করে কয়েকবার ছোটোখাটো বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। কোনো সমস্যায় পড়ে যখন মাকে বলি,তখন মা বলেন, ‘আচ্ছা। এটা নিয়ে ভাবিস না। আমি দেখতেছি।’ এই কথাটির মধ্যে যে কি এক স্বস্তি কাজ করে তা বলে বুঝানো সম্ভব না। ‘মা’, তুমি আমার প্রথম শিক্ষক, তোমার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ, তুমি আমার বন্ধু, তুমি আমার পরামর্শদাতা, তুমি আমার আশ্রয়স্থল, আমি তো তোমারই অংশ। আজ মা দিবসে পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা রইলো।
যে মা’য়েরা পৃথিবীতে নেই, তারাও ভালো থাকুন। আপনার সন্তানের প্রার্থনায়, প্রতিটা পদক্ষেপে আপনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন। শেষে, পৃথিবীর প্রতিটা সন্তানের পক্ষ থেকে প্রতিটা মাকে বললাম, ‘মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
মা কেবল একজন তত্ত্বাবধায়ক নন; তিনি একজন পথপ্রদর্শক
চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষার্থী নিশাত আনান বলেন, একজন মা হলেন ঘরের হৃদয়, ভালোবাসা এবং শক্তির স্তম্ভ। তিনিই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রতিটি মুহূর্তকে বিশেষ করে তোলেন, বাতাসকে উষ্ণতায় ভরিয়ে দেন এবং আমাদের হৃদয়কে নিঃশর্ত ভালোবাসায় ভরিয়ে দেন। আমার মা কেবল একজন তত্ত্বাবধায়ক নন; তিনি আমার পথপ্রদর্শক, আমার শিক্ষক ও আমার সেরা বন্ধু। তার একটি মৃদু কিন্তু শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে যা আমার ভয়কে শান্ত করতে এবং আমার স্বপ্নকে উৎসাহিত করতে পারে।
তার ভালোবাসার কোন সীমা নেই, এবং তার ত্যাগ অসীম। ছোট ছোট দৈনন্দিন জিনিস হোক বা দয়ার মহৎ কাজ, তিনি নিঃস্বার্থভাবে সবকিছু দান করেন। তার জ্ঞান আমার চরিত্র গঠন করে, তার ধৈর্য আমাকে স্থিতিস্থাপকতা শেখায় এবং তার দয়া আমার জন্য অনুসরণ করার জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করে।
মায়ের ভালোবাসার কথা তুলে ধরে নিশাত বলেন, আমি যখন দুঃখিত থাকি, তখন আমার মায়ের আলিঙ্গনই আমার নিরাপদ বোধ করার জন্য প্রয়োজন। যখন আমি খুশি থাকি, তখন তিনি আমার সাথে এমনভাবে উদযাপন করেন যেন আমার আনন্দগুলিও তার। প্রতিটি উপায়ে, তিনি আমাকে লালন-পালন করেন, আমাকে আজকের ব্যক্তিতে পরিণত হতে সাহায্য করেন।
মায়ের ভালোবাসার চেয়ে বড় সম্পদ আর কিছু নেই, এবং তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার গভীরতা কোনও শব্দেই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠতে পারে না। তিনি আমার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, এবং আমি প্রতিদিন তার জন্য কৃতজ্ঞ।
মায়ের প্রতিটি কথায় লুকায়িত থাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা!
সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিম রহমান মায়ের শূন্যতা অনুভব করে বলেন, বাড়ি থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে অভিনব স্বপ্নের খুজে এখন আমি মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে। দূরের অপরুপ সৌন্দর্যের মাঝেও মনের ভেতরের অস্থিরতা থেমে থাকেনা। মায়ের কাছ থেকে দূরে এসে বুঝেছি মায়ের শূন্যতা। মা সঠিক সময়ে খাবার পানি তুলে দিতো; নিজে না খেয়ে আমার জন্য রেখে দিতো কিন্তু এখন তার বদলে শুধু নিঃশব্দতা!
মা যখন ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে খাবার খেয়েছিস? শরীর ভালো আছে? সারাদিন কি করেছিস? তখন তার প্রতিটি কথার মাঝে লুক্কায়িত থাকে চিন্তা ও নিস্বার্থ ভালোবাসা! যখন বলি ভালো আছি তখন, মায়ের কন্ঠে শান্তির ছায়া নেমে আসে!
রাজশাহী শহর টা অনেক সুন্দর কিন্তু এখানে মায়ের আদর ও ভালোবাসার শূন্যতা প্রতিদিনই টের পাই! তবুও তিনশো কিলোমিটার দূরে থেকেও মা যেন প্রতিটি নিশ্বাসে আমার খবর রাখেন। আজ বিশ্ব মা দিবসে বিশ্বের সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইলো।
পৃথিবীতে মা বেঁচে থাকাই সবচেয়ে বড় নিয়ামত
ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান বলেন, আমাদের সবার জীবনে সবচেয়ে কাছের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ও সবচেয়ে যত্নশীল ব্যক্তিটি আমাদের মা। নিঃস্বার্থ ও অফুরন্ত ভালোবাসা, আমাদের সেবায় দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম, আমাদের সুখের জন্য হাসি মুখে সকল কষ্ট সহ্য করে নেওয়া সেই অবহেলিত ব্যক্তিটিই আমাদের মা। আজ বিশ্ব মা দিবসে সেই সকল মায়েদের জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
অক্টোবর ২০২৩, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো পারি জমিয়েছিলাম বাড়ি থেকে অনেক দূরের শহরে। এখনও মনে পরে, আমাকে রেখে যেতে এসে ঐদিন কতটা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল আমার মা। রাতে ফোন দিয়ে আমাকে বলেছিল, জানিস নুসরাত আমার জীবনে এর আগে কোনো দিন কোনো কিছুতে এতোটা কষ্ট হয় নাই, আসলে মায়েদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়তো কোন সঙ্গা দিয়ে সঙ্গায়িত করা সম্ভব নয়। খুব মিস করি মাকে। যখন কান্না পায় ইচ্ছা করে দূরুত্বকে তুচ্ছ করে ছুটে যাই মায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরি, আবার ফিরে যাই শৈশবে।
তিনি বলেন, মায়ের সময়টা আমাদের সবার জীবনে সান্নিধ্যে সুন্দর একটি সময় যেটি আমরা সময় থাকতে বুঝিনা। তাই আপনাদের যাদের মা বেঁচে আছেন এবং যারা মায়ের সাথে আছেন তারা মায়েদের যত্ন নিন, মায়ের কাজে সাহায্য করুন। যারা দূরে থাকেন নিয়মিত ফোন দিয়ে তাদের খোঁজ নিন। শুধু দিবসে ফেসবুক পোস্ট- এই যেন মায়ের প্রতি আবেগ ও ভালোবাসা সীমাবদ্ধ না থাকে। সেই দিকে সচেতন হন। সর্বোপরি, তাদের অনেক ভালোবাসুন, তাদের সুস্বাস্থ্য কামনা করুন। কারন, পৃথিবীতে মা বেঁচে থাকা সবচেয়ে বড় নিয়ামত।
মায়েদের কোনো দিবস হয় না
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী তারিফুল ইসলাম বলেন, আসলে মা’কে ভালোবাসার জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন নাই। প্রতিটি মা তার সন্তানের কাছে অমূল্য রত্ন। যিনি কোলে-পিঠে করে বড় করেন এবং সারাজীবন আগলে রাখেন তাকে নিদিষ্ট দিনে ভালোবাসা আসলে বেমানান। মায়েদের ভালোবাসার জন্য কোনো বিশেষ দিনের প্রয়োজন নেই। আর যদি দিবস দিতেই হয়, তাহলে প্রতিটি দিনই মা দিবস হওয়া উচিত। তবুও বিশ্ব মা দিবসে পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সবকিছুই ফিকে, কেবল ‘মা’ সত্য
সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান বলেন, মা, শব্দটি আমরা শুধু বইয়ে পড়ি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে চোখের সামনে দেখি৷ আমরা কখনাে এই শব্দটির উপর তেমন গুরুত্ব দিয়ে কখনাে ভাবি-ই নি৷ আসলে আমরা ভাবি আমাদের চারপাশের বন্ধু বান্ধবই আমাদের সব৷ আসলে,তা নয়৷ আমার মা আমার সব৷ আমার প্রতিটি মুহূর্ত তার জন্য কােরবানি করা উচিত কেননা, তিনি পরিশ্রম করে আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছেন৷ আমার পেছনে আমার সব কিছুই ফিকে -কেবল আমার মা সত্য৷
মা দিবস শুধু একটি দিনের উদযাপন নয়, এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে মায়ের ভালোবাসা তেমনি আমাদেরও উচিত প্রতিদিন তাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেওয়া। আসুন, শুধু মা দিবসেই নয়, বছরের প্রতিটি দিনে মাকে ভালোবাসি, তার যত্ন নিই এবং কৃতজ্ঞতা জানাই।