কোটা-সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ধারাবাহিক ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষন করলে সহজেই রাষ্ট্রযন্ত্রের কুৎসিত ও কদর্যপূর্ণ রূপের অনুমান লাগানো সম্ভব।উক্ত আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থপরতা,দ্বায়িত্বহীনতা ও অপরিণামদর্শিতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।এমতাবস্থায় এতটুকু উপলব্ধি করা যায় যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমাধান আপাতদৃশ্যমান একটি সমস্যার সমাধান হলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় খুটি বেঁধে বসা প্রাণঘাতী ব্যাধি সমূহ যা উক্ত আন্দোলনের বাই-প্রোডাক্ট (উপজাত) হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে সেগুলোর কোনো যথাযথ সমাধান নয়।
সরকার,বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজ নিজ দ্বায়িত্ব পালনে শুধু অপারগ না বরং রীতিমতো দ্বায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে।সম্পূর্ণ আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকার পুরোপুরি একরোখা ও অপরিনামদর্শী আচরন দেখিয়ে গিয়েছে।
সূচনালগ্ন থেকেই শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে থাকলেও “অযৌক্তিক আন্দোলন,সরকার বিরোধী আন্দোলন” ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বিভিন্ন ট্যাগ ও তুলনা প্রদান করে নানারূপ মন্তব্য দিয়ে গেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও নেতাকর্মীরা। “আন্দোলনকারীদের জবাব দিতে ছাত্রলীগ প্রস্তুত” বলে বিবৃতি প্রদান করেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ১৮ই জুলাই সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে নীতিগত একমত প্রকাশ করে সরকার। অযৌক্তিক আন্দোলনের মতো শব্দ, বিভিন্ন ট্যাগিং ব্যবহার না করে প্রারম্ভিক পর্যায়ে একমত পোষন করলে এতোগুলো প্রাণহানি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো। ক্ষমতাসীন সরকার শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যেমে শুরুতেই যে সমাধানের পথে হাটতে পারতো,সেই পথে আন্দোলনকারীদের আহবান করেছে সাধারন শিক্ষার্থীদের রক্তের উপর হেটে।কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্র ও আন্দোলন জনিত সহিংসতা এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের অপারগতা কোনোভাবেই অস্বীকার করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।
যে দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকুক না কেনো,যে কোনো আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আখ্যায়িত করার মাধ্যমে দমন করার সংস্কৃতি বাংলাদেশের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কোটা-সংস্কার আন্দোলনকেও বারবার রাষ্ট্র-বিরোধী, সরকার বিরোধী ঘোষনা করা হয়েছে। পাশাপাশি চর্চা করা হয়েছে দোষারোপের রাজনীতির,যেখানে সরকার ও বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দ একে অপরকে বারংবার দোষারোপ করে গেছেন।কোটা-সংস্কার আন্দোলনকে হাতিয়ার করে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকেও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে শুরু থেকেই।পক্ষান্তরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বরাবরই ঘোষনা এসেছে যে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে আন্দোলনে নামবে না। পক্ষান্তরে এই আন্দোলনকে পুজি করে কুচক্রী ও ষড়যন্ত্রকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশব্যাপী সহিংসতা চরম পর্যায়ে পৌছে যায়।কোটা-সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে স্বাধীন বাংলাদেশে অপরাজনীতি চর্চার স্বাধীনতা ও তার কুৎসিত রূপের যে চিত্রায়ন হয়েছে তা বহুকাল ধরে তান্ডব চালাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার জনগণের উপর।
নোংরা রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দূর্ভাগ্যে জুটেছে ঘুণে ধরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকেই কোটা-সংস্কার আন্দোলনের ডাক উঠেছিলো যা পরবর্তীতে সকল সাধারন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের রূপ নেয়। ক্রমান্বয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বিভিন্ন প্রভাবকের কারণে সহিংসতার রূপ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত সকল শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিতের দ্বায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরের উপর ন্যাস্ত হলেও তারা পুরোপুরি ভাবে ব্যার্থ। উপরন্তু প্রত্যেকেই পেশাদারী আচরনের বিপরীতে দায়সারা মনোভাব ও অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে থাকা শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে পুরোপুরি অপারগতা প্রকাশ করেছে হল প্রভোস্টরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এরূপ অনাগ্রহী মনোভাবের প্রধান কারণ হিসেবে প্রতিটি সেক্টরে জবাবদিহিতা নিশ্চায়ন করার প্রচলন না থাকার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। এই অ-জবাবদিহিতা গণমানুষের সেবায় নিয়োজিত প্রতিটি সেক্টরে দৃশ্যমান, যা রাষ্ট্রের দ্বায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান গুলোর কদর্যতা চিত্রায়িত করে।
কোটা-সংস্কার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরন বেপরোয়া ও অনিয়ন্ত্রিত। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহতের ঘটনা সেটার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হাতে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও তাকে লক্ষ্য করে একের পর এক গুলি চালিয়ে যাওয়া দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চূড়ান্ত অপেশাদারিত্ব ও নিয়ন্ত্রণহীন চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ।
আন্দোলনকে ঘিরে ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে লাগামহীন ‘পাওয়ার প্রাক্টিস’ এর সংস্কৃতি। হাসপাতালে আহত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা তারই প্রমান বহন করে। এছাড়াও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরকে হুমকি,ভীতিপ্রদর্শন ও মারধরের মাধ্যমে বলপূর্বক আন্দোলনে বাধা প্রদান করতে দেখা গিয়েছে। কোন সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী ছাত্রদের মারধর ও হুমকি প্রদর্শন করেছে তা স্পষ্ট না।
যে সরকারই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক না কেনো তার অঙ্গ সংগঠন ও এসবের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক দিয়ে ফুলে ফেপে ওঠার প্রবণতা আজন্মকাল ধরে বাংলাদেশে চলে আসছে। এটি ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির সহ সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। এই “পাওয়ার প্রাক্টিস” এর বিষ-দংশনে পুরো দেশে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে।
ধ্বংসস্তুপের উপর হেটে নয় বরং শান্তিপূর্ণ পথেই কোটা-সংস্কার আন্দোলনের সমাধান চেয়েছিলো সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে দেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও সংগঠনগুলোর অপ্রত্যাশিত রূপ। যা ক্যান্সারের ন্যায় বিস্তার লাভ করেছে সবখানে।রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকায়িত ব্যাধিগুলোর চিরস্থায়ী নির্মূল ব্যাতিত রাষ্ট্রযন্ত্রের ও তার জনগণের সুষ্ঠু বিকাশ কখনোই সম্ভব না।তাই এসব ব্যাধি নির্মূলের জন্য অবিলম্বে দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।
লেখক, বখতিয়ার নাসিফ আহমেদ, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।