ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে প্রায় পাঁচ মাস আগে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘লংমার্চ টু ঢাকা’-এর দিনই পদত্যাগ করে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ভারতের অকৃত্রিম মিত্র শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণ করে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
এরপরই সামনে আসতে থাকে ১৬ বছরের শাসনামলের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, গুম ও হত্যাকাণ্ডের চিত্র। এ সব অপরাধের দায়ে এখন পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় দুই শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার মধ্যে ৮০ শতাংশেরও বেশি হত্যা মামলা। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ যাবৎ একটি মামলাই দায়ের করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। গুম, ক্রসফায়ার, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ড এবং গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে হত্যাকাণ্ড চালানোর অভিযোগে এই মামলা।
শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার বা দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করার নানা প্রক্রিয়ার কথা বলছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এই মর্মে, গত ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্টারপোলকে রেড অ্যালার্ট (লাল সতর্কতা) জারি করার জন্য আবেদন জানায়। কিন্তু এরপর এনসিবি পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছে কি-না বা ইন্টারপোল শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে কি-না তা এখনও নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছেন খোদ চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
এরই মধ্যে সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠাতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর ‘নোট ভার্বাল’ বা আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক বার্তা পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটি মূলত এমন এক ধরনের বার্তা যা নিরপেক্ষ ঘরানার তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে পাঠানো হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রও নোট ভার্বাল পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন। এমতাবস্থায় প্রশ্ন হলো যে কাছের বন্ধুকে আন্তর্জাতিক মহলের চোখরাঙ্গানি উপেক্ষা করে লাল পাসপোর্ট ছাড়াই দুই মাস ধরে নিজেদের দেশে নিরাপদে আশ্রয়ে রেখেছে ভারত, বাংলাদেশ চাওয়া মাত্রই কি তাঁকে ফিরিয়ে দিবে তাঁরা?
ভারতের ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের জটিলতা বিবেচনা করলে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রশ্নটি সহজ কোনো সমাধান পাওয়ার বিষয় নয়। যদিও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে সচেষ্ট, ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ এবং আঞ্চলিক রাজনীতি এতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
শেখ হাসিনা ভারতীয় রাজনীতিতে বহুদিন ধরে একটি কৌশলগত সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতের বিভিন্ন অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করেছে। তিস্তার পানি বণ্টন থেকে শুরু করে সীমান্ত নিরাপত্তা এবং বিদ্যুৎ সহযোগিতা—প্রায় সবক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্বে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছায়। তাই খুব বেশি বিস্ময়কর ঘটনা না ঘটলে, ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত তাদের জন্য রাজনৈতিক ক্ষতি হিসেবেই চিহ্নিত করতে পারে।
এ ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি আন্তরিকভাবে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনতে চায়, তবে তাদের জন্য কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নিশ্চিত করাটা জরুরি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে যথাযথ স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত করার মাধ্যমে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন সম্ভব।
তবে এ প্রক্রিয়া কেবল আইনি নয়, বরং রাজনৈতিকও। শেখ হাসিনার মতো উচ্চপ্রভাবশালী একজন রাজনৈতিক নেত্রীকে ফেরত আনা শুধুমাত্র আদালতের রায় বা রেড অ্যালার্টের উপর নির্ভর করে সফল হবে না। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের চাপ সৃষ্টি, শক্ত ও দৃঢ় কূটনৈতিক তৎপরতা এবং জনসমর্থনের সমন্বয়ে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করতে হবে।
আরএস