আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন মানবতার ভবিষ্যৎ নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তখন সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘ইউএন সামিট অব দ্য ফিউচার’-এ পৃথিবীর ক্ষতি না করে কীভাবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টির যোগান দেওয়া যায় সেই প্রশ্নটি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে।
২০১৯ সালের তুলনায় গত বছর বিশ্বের ১৫ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল। সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ৭ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ ভুগেছেন অপুষ্টিতে। যা পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করে বিশ্ববাসীর পর্যাপ্ত খাদ্যের যোগান দেওয়ার বিষয়টিকে আরও অনিরাপদ করে তুলেছে।
একই সময়ে, ক্ষতিকর গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন কমাতে খাদ্য ব্যবস্থাগুলো ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রয়েছে, যার এক-তৃতীয়াংশ মানবসৃষ্ট কারণে হয়ে থাকে। উপরন্তু, এই এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে আবার দুই-তৃতীয়াংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন ঘটে থাকে মাটি দূষণের কারণে।
ভবিষ্যতের বৈশ্বিক পুষ্টির চাহিদা টেকসইভাবে পূরণে তাই আমাদের ক্রমবর্ধমানভাবে মাছ এবং অন্যান্য জলজ খাদ্যের ওপর নির্ভর করা উচিত, যার উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবেশগত প্রভাব স্থলভিত্তিক প্রাণিজ খাদ্যের তুলনায় কম।
ইতিমধ্যে জলজ খাদ্য বৈশ্বিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বর্তমানে আহরিত ছোট আকারের মাছের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ৯৮ কোটি ৭০ লাখ নারীর ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের পুষ্টি চাহিদার অর্ধেক পূরণ হচ্ছে। স্বাদু পানি সংবলিত ছোট ঘেরে চাষকৃত ঝিনুক এবং শামুক মুরগির মাংসের তুলনায় ৭৬ গুণ বেশি ভিটামিন বি-১২ এবং পাঁচ গুণ বেশি লৌহ সরবরাহ করে থাকে।
তবে প্রয়োজনীয় উৎপাদন ও সরবরাহ বজায় রাখতে মাছের মজুদ ও জলজ বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করা এবং রক্ষণাবেক্ষণে আরও বেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি উদ্ভাবনী দৃষ্টি দিতে হবে। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক মাছের মজুদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আহরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মহাসাগরগুলোর তাপমাত্রা ও লবণাক্ততার মাত্রার পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত ইউট্রোফিকেশন অর্থাৎ জলাশয়ের তলদেশে অস্বাভাবিক হারে শৈবালের জন্মের কারণে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
আমার সংগঠন ওয়ার্ল্ডফিশ যেসব দেশে কাজ করে, সেখানে আমরা মাছ ও জলজ খাদ্য উৎপাদনে বিনিয়োগের সুফল দেখেছি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পূর্ব তিমুরে স্কুলের খাবারে টাটকা তেলাপিয়া মাছ যুক্ত করায় শিশুদের মধ্যে প্রোটিন, ওমেগা-৩, ভিটামিন ও খনিজ গ্রহণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তাদের স্বাস্থ্যকর বেড়ে ওঠা ও উন্নয়নের জন্য সহায়ক। পাশাপাশি, ভারতের আসামে সপ্তাহে তিনবার স্কুলের খাবারে মাছের গুঁড়া যোগ করে শিশুদের খর্বাকৃতির সমস্যা হ্রাসে এবং গড় বডি মাস ইনসেক্স (বিএমআই) বৃদ্ধিতে অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া গেছে।
অধিকন্তু, আমাদের বিজ্ঞানীরা নির্বাচিত প্রজনন পদ্ধতি ব্যবহার করে সাধারণভাবে আহরিত তেলাপিয়া ও রুইয়ের মতো মাছের প্রজাতির জাত উন্নত করেছেন। এতে মৎস্যগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত কম সময়ে বড় হচ্ছে। এই পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে মাছচাষিরা যেমন অধিক লাভবান হচ্ছেন, তেমনি অধিক পুষ্টিকর খাদ্য অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই দ্রুত সরবরাহ শৃঙ্খলে পৌঁছাচ্ছে, যা কৃষক বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।
পাশাপাশি, সাধারণ মাছের রোগ শনাক্তকরণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার মাছের স্বাস্থ্যকে আরও উন্নত করেছে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রোগের কারণে মাছ মরে দূষণ ঘটার সম্ভাবনাও হ্রাস পেয়েছে।
মাছ এবং জলজ খাদ্য উৎপাদনে টেকসই উন্নয়ন বাণিজ্য ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি (SADC)-এর প্রোগ্রাম ফর ইমপ্রুভিং ফিশারিজ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ব্লু ইকোনমি ট্রেড করিডোরস (PROFISHBLUE) তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বিশ্বব্যাপী এই উদ্ভাবনগুলোর প্রসার ঘটিয়ে আমরা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় বিপুল অগ্রগতি ঘটাতে পারি, যা স্বাস্থ্য ও জীবিকার উন্নয়ন এবং সামাজিক সমতা নিশ্চিতে অধিকতর ভূমিকা রাখবে। কেননা আমাদের মনে রাখা উচিত, ভবিষ্যতের খাদ্য ব্যবস্থায় আরও বেশি মাছের প্রয়োজন হবে, এবং সেই ভবিষ্যৎ শুরু হয়েছে এখন থেকেই।
• ইশাম ইয়াসিন মোহাম্মদ, আন্তর্জাতিক মৎস্যবিষয়ক সংগঠন ওয়ার্ল্ডফিশ-এর ডিরেক্টর জেনারেল
• আল জাজিরা হতে নেওয়া,
• ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে ভাষান্তর: রুশাইদ আহমেদ