ইরানের রাজধানী তেহরানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার জেরে ইসরায়েলে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি।
বুধবার (৩১ জুলাই) ইসলামী বিপ্লবী গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাতে এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’।
সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইরানের আইআরজিসির জ্যেষ্ঠ দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার জবাবে পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনি। ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিঘ্নিত করার প্রতিশোধ এবং চলমান উত্তেজনায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শনই এ হামলার লক্ষ্য বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।
বুধবার সকালে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে খামেনি এই আদেশ দেওয়ার পরই ইথেকেই দেশটির আইআরজিসি ও সামরিক বাহিনী অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি শুরু করেছে বলে জানা গিয়েছে।
এ ছাড়াও, বিষয়টি নিয়ে ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তাসংস্থা ইরনা খামেনির এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তাতে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনি হানিয়াকে হত্যার জন্য ইসরায়েলকে ‘কঠোর শাস্তি’ দেওয়ার অঙ্গীকার করে বলেছেন, হানিয়াকে হত্যার এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের জায়নবাদী অপরাধী ও সন্ত্রাসী শাসকদের জন্য কঠিন শাস্তি পাওয়া বৈধ হয়ে গিয়েছে। ইরানি ভূখণ্ডেই হানিয়ার রক্তপাত হওয়ায় প্রতিশোধ নেওয়া এখন ইরানের দায়িত্বে পরিণত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন এই শিয়া নেতা। এ ছাড়াও, হানিয়ার মৃত্যুতে বুধবার থেকে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে দেশটিতে।
এ দিকে, হামাসের রাজনৈতিক প্রধান হানিয়ার মৃত্যুর পর ইরানের নিরাপত্তার প্রভাব সম্পর্কে তেহরানের সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ফেলো আবাস আসলানি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার কাছে নিজের বিশ্লেষণ তুলে ধরে বলেছেন, তেহরানে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য খুবই বাজে উদাহরণ হয়ে থাকবে। ফলে স্বভাবতই ইরান এই ঘটনার পাল্টা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দারুণ উদগ্রীব হয়ে উঠবে।
তিনি আরও মনে করেন যে, ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এ ঘটনাটি একটি হুমকিস্বরূপ হওয়ায় দেশটির পক্ষ থেকে একটি প্রতিশোধ নেওয়া বা কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তবে আসলানি তাঁর বিশ্লেষণে প্রতিক্রিয়ার মাত্রা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত কোনো মন্তব্য করেননি ইরান এখনও প্রকাশ্যে বিষয়টি নিয়ে কিছু না বলায়। অবশ্য এ ধরনের হামলার ঘটনা যে ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা সমগ্র বিশ্বের মানুষই অনুধাবন করছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অপর দিকে, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি হানিয়ার রক্ত কখনোই ব্যর্থ হবে না মন্তব্য করে বলেন, ইসমাইল হানিয়ার রক্ত কোনো অবস্থাতেই বৃথা যেতে পারে না। তেহরানের মাটিতে তাঁর শাহাদতবরণ ইরান, ফিলিস্তিন এবং প্রতিরোধকারী সংগ্রামীদের মধ্যে বিদ্যমান গভীর এবং দৃঢ় বন্ধনকে আরও করে তুলবে অটুট।
তবে ইরান ও হামাস হানিয়ার গুপ্তহত্যা জন্য ইসরায়েলকেই দুষলেও ইসরায়েল এ অভিযোগের বিষয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। এমনকি, আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্রদের কাছে বিষয়টি নিয়ে তাঁদের বক্তব্য জানতে চাইলেও তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে কয়েকবছর আগে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী এবং সামরিক কমান্ডারসহ বিদেশে শত্রুদের হত্যা করার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পৃক্ততার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুযায়ী।
অবশ্য ইসরায়েল সরকার হানিয়ার নিহতের খবরে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য না করলেও আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে হামাসের এই রাজনৈতিক প্রধানের মৃত্যুতে। এই উল্লাসকারীদের সারিতে রয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী থেকে শুরু করে বেশ কিছু সাধারণ মানুষও। তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে উল্লাস প্রকাশ করে প্রকাশ্যেই তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করছেন। এদের মধ্যে ইসরায়েলের ঐতিহ্যবিষয়কমন্ত্রী আমিচে এলিয়াহু হানিয়ার নিহত হওয়ার ঘটনায় বিশ্ব আরেকটু বাসযোগ্য হলো বলেও মন্তব্য করেছেন।
পরে বুধবার এক জরুরি বৈঠক শেষে উগ্র ডানপন্থী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর দেশ যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বাঙ্গীণভাবে প্রস্তুত রয়েছে বলে দাবি করেন।
বুধবার (৩১ জুলাই) সকালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া গুপ্তহত্যার শিকার হন। ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হানিয়া মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) তেহরানে গিয়েছিলেন। পরে যে ভবনে হামাসের নেতৃবৃন্দ ছিলেন, সেখান হতে বুধবার সকালে একজন দেহরক্ষীসহ হানিয়ার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
পরে বিষয়টি নিয়ে এক বিবৃতিতে হামাস জানায়, তেহরানের একটি বাসভবনে আমাদের ফিলিস্তিনের সংগ্রামী ভ্রাতা ও নেতা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান ইসমাইল হানিয়া বিশ্বাসঘাতক জায়নবাদীদের হামলায় শহিদ হয়েছেন। এ ঘটনায় ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব ও ইস জাতি এবং বিশ্বের সকল স্বাধীন মানুষের কাছে সর্বাত্মক শোক পালনের আহ্বান জানাচ্ছে।