আল কাসাম ব্রিগেড হলো হামাসের মিলিটারী উয়িং। এই নামকরণ হয় ফিলিস্তিনি যোদ্ধা আল কাসামের নামে যিনি ১৮৮২ সালেসিরিয়ার ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী শহর জাবলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন পারিবারিক শিক্ষায়। সেসময় জাবলা শহরে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। তাই আল কাসসামের শৈশব কাটে বাবা আব্দুল লতিফের ইসলামিক শরিয়াহ, আল কুর’আন, আরবি ভাষা-ক্যালিগ্রাফি-সাহিত্য শিক্ষায়। আব্দুল লতিফ ছোটকালেই ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনে আল কাসামকে আগ্রহী করে তোলে যার ফলাফল পাওয়া যায় তার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে।
মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান আল কাসাম যেখানে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন ও প্রতিবাদ স্বচক্ষে তিনি দেখতে পান। পরবর্তীতে ১৯১১ সালে জাবলা শহরের রাস্তায় মিছিল নেতৃত্ব দেন ইতালি উপনেশবাদীরা লিবিয়ার ত্রিপোলি শহর দখল করে নিলে। ১৯২০ সালেও এমন ঘটনা ঘটে, তবে তা আরও নাটকীয় রূপ নেয়। আল কাসাম ভিটেমাটি বেঁচেচব্বিশটা বন্দুক কিনে ফ্রেঞ্চ কলোনিয়ালদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে যখন তারা সিরিয়া দখল করতে আসে। ততদিনে তার বেশ নামডাক হয়ে যায় মিছিল ও আন্দোলনের মাঠে। ফ্রেঞ্চ কলোনিয়ালরা তাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় এবং অবশেষে আল কাসামকে জেলে পাঠায়। পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় লাটাকিয়াতে। কিন্তু তিনি পালিয়ে যান এবং প্রথমে দামেস্ক ও পরবর্তীতে হাইফা অঞ্চলে এসে বসবাস করা শুরু করেন যা ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের অংশ। সেখানে তিনি আল কুর’আন শিক্ষা ও জিহাদের ধারণাগুলো নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। আল কাসাম সেখানকার মজুর-কারিগর-কুলি-মিস্ত্রীদের শিক্ষক হয়ে ওঠেন যারা ১৯২০ সালেরপরে জায়োনিস্টদের দ্বারা বিতাড়িত, অবহেলিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছে। “ওয়াইএমসিএ মুভমেন্ট” ও “মুসলিম ইয়োথ অ্যাসোশিয়েশন” গড়ে তোলা হয় আল কাসামের তত্ত্বাবধানে ।
১৯৩০ সালে তিনি হাইফা শহরের শরিয়া কোর্টে জজ নিযুক্ত হন। ততদিনে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছেন। তার বাড়িতে চলত গোপন মিটিং এবং সেখানে তাদেরই স্থান হতো যারা জিহাদের জন্য যেকোনো সময় জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত। ছোট ছোট ইউনিট মিলে একটা বড় জিহাদী দল গড়ে তোলা হয় যার মধ্যে অস্ত্র কেনা, ব্রিটিশ ও জায়োনিস্টদের উপর নজরদারি করা, মিলিটারীট্রেনিং, তথ্য সংগ্রহ ও জনবল তৈরী করার মতো কাজ ভাগ করা থাকত। ইউনিটগুলো গড়ে উঠলে, তাদের অ্যাক্টিভিটি জায়োনিস্টদের নজরে পড়ে যায়।এমনকি ব্রিটিশ সরকার থেকে ডাবল এজেন্ট বানানোর চেষ্টা করা হয় আল কাশেমের মুক্তিবাহিনীর মধ্যে।
১৯৩৫ সালের ২০ নভেম্বর। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামে একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। ইয়াবুদের জঙ্গলে ব্রিটিশ ফোর্স বহু আল কাসামের যোদ্ধাদের (যারা কাসেমিয়ান ও ইখওয়ান আল কাসাম নামে পরিচিত ছিল) হত্যা করে, আগুনে জ্বালিয়ে দেয় এবং বাকিদেরকে জেলবন্দিকরা হয়। সেসময় আল কাসাম যোদ্ধাদের অস্ত্র বলতে ছিল প্লাস্টিক বন্দুক, ছুরি, পাথর ও হাতে বানানো বোমা। এই ঘটনায় আল কাসাম শহিদ হন। তবে শত বছর ধরে এখনো তার নাম ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামী ও স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে।
১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে সিনাই ও গোলান মালভূমিকে ঘিরে ইসরায়েলের যুদ্ধ ঘটল জর্ডান, মিশর ও সিরিয়ার সাথে। আরব ওফিলিস্তিনিদের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে আসল এই যুদ্ধের পরিণতি। একে একে নিজেদের ভূমি হারাতে শুরু করল ফিলিস্তিনিরা। সেসময় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) রাজনৈতিক ও সামরিক দুই ক্ষেত্রেই সক্রিয় ছিল।পিএফএলপি, পিডিএফএলপি ও পিডিএফএলপি-জিসি, পিএলএফ ও পিএলএ, আল সাকা ও ফাতাহ মিলে একত্র ছিল পিএলও।ইজরায়েলি ফোর্স এবং অবৈধ জুয়িশ বসতিস্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে সকল প্রকার মিলিটারী অপারেশন চালাতো পিএলওয়ের বামপন্থীইউনিটগুলো। কিন্তু নব্বই দশকের দিকে প্যালেস্টাইন মিলিটারী সংগঠনগুলোর অস্ত্র সাপ্লাই কমে যায় মিশরের বর্ডার অঞ্চলে ইজরায়েলের কড়া নজরদারির জন্য। কিন্তু ঘটনা মোড় নিতে শুরু করে দ্বিতীয় ইন্দিফাদার সময় ২০০০ সালে এবং সেটা ১৯৮৭ সালেপ্রতিষ্ঠিত হামাসের হাত ধরে। সাতষট্টির যুদ্ধের পরে যেসব অস্ত্র-গোলাবারুদ সিনাই অঞ্চলে থেকে যায় সেসব মিশর থেকে হামাস সুড়ঙ্গের মাধ্যমে গোপনে আমদানি করতে থাকে এবং গাজা থেকে পশ্চিম জেরুজালেমেও সেসব তারা পাচার করত।
হামাসের মিলিটারী উয়িং আল কাসাম ব্রিগেডে রিক্রুটমেন্ট হত মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলন ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে। তাদেরকে ধর্মীয়ভাবে অনেক বেশি আত্মত্যাগী হতে হত এই পথে আসতে। কিন্তু যদি টাইমলাইন দেখা হয় তাহলে আল কাসাম ও হামাসের সময়মিলবে না। কারণ আল কাসাম ব্রিগেডের পুরনো সংস্করণের অস্তিত্ব হামাসের বহু আগেই থেকেই ছিল খণ্ড-বিখণ্ড অবস্থায়। কিন্তু হামাস যখন ১৯৮৭ সালে গঠিত হয়, তখন সিরিয়ান মুসলিম মুহাম্মদ আল কাসামের নামে “ইজ আদ-দ্বীন আল- কাসাম ব্রিগেড” গড়ে ওঠে পলিটিক্যাল পার্টি হামাসের মিলিটারী উয়িং হিসেবে। যদিও বেশ কয়েক বছর হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ও পলিটিক্যাল লিডাররা হামাসের সাথে আল কাসাম ব্রিগেডের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে যান সম্ভবত পলিটিক্যাল কারণেই। এমনকি তাদের এমন স্টেটমেন্টও পাওয়া যায় যেখানে তারা বলেছেন যে, আল কাসাম ব্রিগেডের অপারেশনের দায় হামাস নিবে না। সেসময় হামাসেরপ্রতিষ্ঠাতা শায়েখ আহমেদ ইয়াসিন ইজরায়েলে জেলবন্দি ছিলেন। শায়েখ ইয়াসিন জেলে থাকতেই জানতে পারতেন আল কাসাম ব্রিগেডের গতিবিধি। আল কাসাম ব্রিগেডের অন্যান্য সংগঠন আল জিহাদ আল ইসলামি ও আল আকসা ব্রিগেডের সাথে যোগাযোগ সে সময় বেড়ে যায় প্রয়োজনে। ইজরায়েলিদের থেকে বিভিন্ন ধরনের চাপপ্রয়োগের ফলে তারা মিলিত হয়ে বেশ কয়েকটা যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। তার অন্যতম সাক্ষী হলো বিরানব্বইয়ের প্রথম ইন্দিফাদা যখন হামাস ও ফাতাহের মিলিটারী উয়িং মিলে যৌথঅভিযান চালায়। কিন্তু ২০০৬ সালের ইলেকশনে হামাস বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে পলিটিক্যাল লিডাররা মিলিটারী উয়িং নিয়েসতর্ক হতে শুরু করে যাতে সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
যেই আল কাসাম ব্রিগেডের উত্থান হাতে বানানো বোমা, ছুরি ও প্লাস্টিক বন্দুক দিয়ে হয়েছিল, সেই বাহিনী এখন অনেক উন্নত প্রযুক্তিরঅস্ত্র-সরঞ্জাম তৈরী করে। এমনকি তাদের সাধারণ বোমাগুলোও আমেরিকান ও চাইনিজ স্ট্যান্ডার্ড লেভেলের মতো কাজ করতে সক্ষম।আল কাসাম -১ ও আল কাসাম -২ তাদের বানানো অরিজিনাল রকেট মিসাইল যা তারা হরহামেশাই ব্যবহার করে থাকে। হামাসেরনিজেদের বানানো তাই এসব অস্ত্র-সরঞ্জামে লেবেলিং করা থাকে “মেইড ইন গাজা বাই আল কাসাম”।
— রুবায়েত আলম, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
SOURCE:
“Inside Hamas: The Untold Story of the Militant Islamic Movement” -Zaki Chehab