রাবি প্রতিনিধি
“বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না”—কথাটি যেন আজ অবাস্তব প্রহসনে পরিণত হয়েছে। বইয়ের দাম যখন মেঘ ছোঁয়া, তখন সাধারণ শিক্ষার্থীর হাতে জ্ঞানের ভাণ্ডার পৌঁছে দেওয়া এক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রতিবন্ধকতাকে পাথেয় করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ প্রমাণ করেছেন, অসম্ভব শব্দটি শুধুই মনের ভ্রান্তি। আসাদুজ্জামান সিয়াম শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে জয় করে যিনি গড়ে তুলেছেন ‘আহরণ’ এক অনন্য উদ্যোগ, যেখানে বই আর জ্ঞান সবার নাগালের মধ্যে।
স্বপ্নের বীজ: একটি জীবনদর্শনের গল্প
ছোটবেলা থেকেই বই ছিল সিয়ামের নিঃসঙ্গতার সাথী, স্বপ্নের সঙ্গিনী। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে খেলার মাঠে দৌড়াতে দেয়নি, কিন্তু বইয়ের পাতায় পাতায় সে খুঁজে পেয়েছে মুক্তির স্বাদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এই শিক্ষার্থী দেখলেন, বইয়ের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় অনেকেই জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত। এই বেদনা থেকেই ২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, মাত্র পাঁচ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে জন্ম নেয় ‘আহরণ’ একটি স্বপ্ন, একটি প্রত্যয়, একটি বিপ্লব।
“নামটা ভেবেছিলাম অনেক দিন ধরে, সিয়ামের কণ্ঠে গম্ভীরতা। ‘আহরণ’ শব্দটার মধ্যে আছে সংগ্রহ, আরাধনা, আর সাধ্যের মধ্যে জ্ঞান তোলার ইশারা। চেয়েছি, নামেই যেন বোঝা যায়, এটা শুধু ব্যবসা নয়, একটা আন্দোলন।”
যাত্রাপথ: মাটির মাদুর থেকে ভ্রাম্যমাণ আলমারি
শুরুটা ছিল সেকেন্ডহ্যান্ড বই বিক্রি দিয়ে। ধীরে ধীরে যোগ হলো বাংলাবাজারের নতুন বই, কম দামে ভালো গুণমানের পাঠ্যবই। প্রথমে মাটির ওপর বিছানো মাদুর, এখন ভ্রাম্যমাণ আলমারি যেখানে বই কিনতে পারবেন পাঠক, আবার বিনামূল্যে বসে পড়ারও সুযোগ পাবেন। সিয়ামের দিন কাটে ক্লাস আর ‘আহরণ’ এর স্টলে। ফাঁকে ফাঁকে বইয়ের পাতায় চোখ বুলানো আর পাঠকদের সাথে গল্পে মগ্ন থাকা।
“প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকার বই বিক্রি হয়, সিয়ামের মুখে আত্মবিশ্বাস। এটা শুধু আয়ের উৎস নয়, সমাজের জন্য ফেরত দেওয়া কিছু।”
চ্যালেঞ্জ: সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে জয় করা
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সমাজের রূঢ় দৃষ্টিভঙ্গি সিয়ামের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বহুবার। কেউ বলেছেন, ‘তুমি পারবে না’, কেউ বা অবজ্ঞায় উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, শিক্ষক, এমনকি চায়ের দোকানদাররাও হয়ে উঠেছেন তার সহযোদ্ধা। রাতে বইগুলো তাদের দোকানে রেখে দেওয়া হয়, যাতে সকালে সহজে স্টল সাজানো যায়।
“আমার সিনিয়ররা বই কিনতে এসে উৎসাহ দেন, জুনিয়ররা সময় দেন, সিয়ামের চোখে কৃতজ্ঞতা। এটা আমার একার লড়াই নয়, আমাদের সবার স্বপ্ন।”
ভবিষ্যৎ: জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা
‘আহরণ’ কে সিয়াম দেখেন একটি জাতীয় উদ্যোগ হিসেবে। তার স্বপ্ন দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আহরণ’ এর শাখা ছড়িয়ে দেওয়া। পাশাপাশি, একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলা, যেখানে সস্তায় মানসম্মত বই প্রকাশ করা হবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে ই-বুক ও অনলাইন অর্ডার সেবা চালু করারও পরিকল্পনা রয়েছে তার।
“আমি চাই, ‘আহরণ’ শুধু বই বিক্রির দোকান না হয়ে উঠুক, সিয়ামের স্বপ্নের কথা। এটা হোক জ্ঞানের মিলনমেলা, যেখানে সবাই আসবে, শিখবে, বেড়ে উঠবে।”
শেষ কথা: অন্ধকারে আলোর মশাল
সিয়ামের গল্প শুধু একটি ব্যবসায়িক সাফল্যের ইতিহাস নয়, এটা এক তরুণের অদম্য ইচ্ছার কাহিনী। শারীরিক সীমাবদ্ধতা, আর্থিক সংকট, সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। ‘আহরণ’ আজ শুধু একটি বইয়ের স্টল নয়, এটি একটি প্রতীক যা প্রমাণ করে, স্বপ্ন দেখার সাহস থাকলে পথ আপনিই তৈরি হয়। জ্ঞান কখনো কারো একার সম্পত্তি নয়, সিয়ামের শেষ কথাগুলো যেন মন্ত্রের মতো। এটা ছড়িয়ে দিতে হবে, আলোর মতো, বাতাসের মতো। আর আমি সেই আলো ছড়াতে চাই, এক বইয়ে এক পাঠক করে।”