গতবছরের অক্টোবরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আক্রমণ করে প্রায় ১২০০ ইহুদি নাগরিককে হত্যা এবং আরও কয়েকশত জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়।পরে জিম্মিদের উদ্ধারে এবং প্রতিশোধ নিতে হামাসনিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকায় সামরিক-বেসামরিক স্থাপনার তোয়াক্কা ছাড়াই নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। শুরু হয় ইসরায়েল-হামাসের মধ্যকার সবচেয়ে দীর্ঘ সংঘাত। যা অব্যাহত রয়েছে এখনও।
গাজায় বর্বরোচিত ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে হামাসের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে শুরু করে লেবাননের শিয়াপন্থী সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। সংগঠনটির আক্রমণের জবাবও নিয়মিতভাবে দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের একমাত্র ইহুদিরাষ্ট্রটি।
তবে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ইসরায়েলের উত্তরাংশ এবং ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে সিরিয়ার কাছ হতে দখলকৃত গোলান মালভূমি এলাকাই বেশি হিজবুল্লাহর আক্রমণের শিকার হচ্ছে লেবাননীয় সীমান্তবর্তী হওয়ায়। আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১৯৮১ সালে ইসরায়েল মালভূমিটি নিজেদের মানচিত্রে সংযোজিত করে একপেশেভাবে।
অপর দিকে, লেবাননের দক্ষিণাংশে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইসরায়েল প্রায়শই হিজবুল্লাহকে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টায় রয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্যমতে, গাজাযুদ্ধ শুরুর পর থেকে লেবাননে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন বেসামরিক নাগরিক রয়েছে বলেও জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
আর ইসরায়েলের দাবি, এই সংঘাতকালে হিজবুল্লাহর হামলায় ২৩ জন সাধারণ মানুষ ও ১৭ জন ইসরায়েলি সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন।
তবে এই যুদ্ধের মধ্যে দুপক্ষই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পাল্টাপাল্টি হামলার ক্ষেত্রে আপেক্ষিকভাবে সংযমী ভাব বজায় রাখলেও গত শনিবার (২৭ জুলাই) ইসরায়েলের গোলান মালভূমির এক ফুটবল মাঠে রকেট হামলায় ১২ ইসরায়েলি নিহতের ঘটনায় চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে ইসরায়েল। চলমান যুদ্ধের মধ্যে হামাসের হামলার পর এই হামলাতেই ইসরায়েলে সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
এরপরই তারা লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে জোরদার বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে শুরু করেছে। অবশ্য গোলান মালভূমিতে শনিবারের হামলার ঘটনায় হিজবুল্লাহ জড়িত নয় বলে দাবি করলেও ইসরায়েল হিজবুল্লাহর কাঁধেই দোষ চাপাচ্ছে। ফলে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর মধ্যে ক্রমবর্ধমান এই উত্তেজনার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দরজায় আরেকটি যুদ্ধ কড়া নাড়ছে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
বড় ধরনের ইসরায়েলি হামলার আশঙ্কা থেকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও পূর্বাংশের গুরুত্বপূর্ণ ও ঘনবসতিপূর্ণ বেশ কিছু স্থান ইতিমধ্যেই ফাঁকা করে ফেলেছে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।
অপর দিকে, গোলান মালভূমিতে হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সফরের নির্ধারিত সময় শেষ না করেই দেশে ফিরে নিরাপত্তাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বসেন। সেখানে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, হামলার জন্য হিজবুল্লাহকে চড়া মূল্য দিতে হবে। এমনকি এই মূল্য এমন হবে, যা আগে কখনও গোষ্ঠীটিকে দিতে হয়নি বলেও মন্তব্য করেন কট্টর ডানপন্থী লিকুদ পার্টির এই নেতা।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ আরও এক ধাপ উপরে গিয়ে বলেছেন, হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে তাঁর মস্তকের বিনিময়ে এই হামলার মূল্য শোধ করা উচিত!
আরেক কট্টর ডানপন্থী ঘরানার ইহুদি রাজনীতিবিদ ও ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচও হিজবুল্লাহর সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে তাঁর দেশ অগ্রসর হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন।
তবে এমন সর্বাত্মক সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে ইসরায়েল এবং হিজবুল্লাহ উভয়েই প্রচুর ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে বলে মত দিয়েছেন সমরবিদরা। কেননা ওই এলাকায় সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী বলে পরিচিত হিজবুল্লাহর কাছে প্রায় দেড় লাখ অত্যাধুনিক রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের বিপুল ভাণ্ডার রয়েছে। পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্যের আরেক পরাশক্তি ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্সি হিসেবেও কাজ করে থাকে সংগঠনটি।
ফলে হিজবুল্লাহ যদি ইসরায়েলের দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে এই সংঘাতে ইরানের জড়িয়ে পড়ার শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশটি ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছে, লেবাননের মাটিতে ইসরায়েল যদি নতুন কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনার পদক্ষেপ নেয়, তবে তা তাদের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণাম বয়ে আনতে পারে।
এ দিকে, ইসরায়েলি সৈন্যরা এখনও গাজায় হামাস যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। এ পরিস্থিতিতে নতুন আরেকটি যুদ্ধ শুরু করলে তা ইসরায়েলের জন্য সৃষ্টি করবে নতুন চ্যালেঞ্জ। এমনকি একইসঙ্গে দুটি যুদ্ধ পরিচালনায় সবথেকে কাছের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাওয়াও কঠিন হয়ে যেতে পারে দেশটির জন্য।
পাল্টাপাল্টি হামলার সূত্র ধরে ইতিমধ্যেই লেবাননের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে প্রায় ৬০ হাজার ইসরায়েলি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। অনেক কট্টর ইসরায়েলির দাবি, ইসরায়েল সরকার হিজবুল্লাহকে নির্মূল করে ঝুঁকি দূর করুক। আবার উদারপন্থী অনেকের কামনা বন্ধ হোক সব ধরনের সংঘাত।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তার পারদ ক্রমশই নিচে নামছে। তিনি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বাঁচাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করার অংশ হিসেবে গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় নানা জটিল শর্ত জুড়ে দিয়ে ফায়দা উসুলও করতে চান বলে অনেক সমালোচকের দাবি।
এরপরও সরকারের কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের চাপে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে নেতানিয়াহু বড় ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নিলে তা মধ্যপ্রাচ্যকে আরেকটি ভয়াবহ সংঘাতের ঝুঁকিতে ফেলার পাশাপাশি নড়বড়ে করে দিতে পারে ইসরায়েলি রাজনীতিতে লিকুদ নেতার অবস্থানকেও।