আমি তখন ছোট্ট। মাঝে মধ্যে বেতারে খবর শুনি। বাংলাদেশের খুলনা ও ঢাকা কেন্দ্রের খবর শুনতাম। অন্যদিকে কোলকাতার আকাশবাণীর খবর শুনতাম। আমার বাবার খবর শোনার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। বাবা নিয়মিত অপেক্ষাকৃত কম মানের আঞ্চলিক পত্রিকা পড়তো।
১৯৯০ সাল। আমি তখন রেডিওর খবর শুনি। অনুধাবন করতে সমস্যা হতো। ওই ’৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪২টি (ন্যাটো) দেশের সৈন্য সমাবেশ করছে পারস্য উপসাগরে। তখন আগস্ট মাস। বাংলাদেশে তখন বর্ষার শেষ, শীতের আগে। জানুয়ারিতে পুরো শীত। শীতের মধ্যে আমরা তখন আড়ষ্ঠ থাকতাম। খোঁজ-খবর একটু কম পেতাম।
১৯৯১ সাল, জানুয়ারি মাস; পৃথিবী অবাক হয়ে গেল। মানুষ হতবাক হয়ে গেল। বি-৫২ বোমারু বিমান উড়ছে পুরো আরব উলাকা জুড়ে। মরুভূমি এলাকায় চলছে বোমা নিক্ষেপ। । কারা বোমা মারছে? নাম শুনলাম-ন্যাটো বাহিনী। কার ওপর আক্রমণ শানানো হলো? উত্তর এল-কুয়েত দখলকারী সাদ্দাম হোসেনের দেশ ইরাকে চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। প্রতাপশালী সাদ্দাম হোসেনকে মেরে ফেলা হবে নতুবা উৎখাত করা হবে। অবশ্য কয়েক বছর যুদ্ধ চলল। বহু মানুষ মরল। নির্বিচারে সুঠামদেহের এসব আরব্যবাসী মারা গেল। হঠাৎ একদিন ধরা পড়লেন রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন। পরে বিচারে তাঁর মৃত্যু হল। এই যুদ্ধের তাত্ত্বিক নাম ছিল- গালফ ওয়্যার। এই যুদ্ধে লাভ কার-আমেরিকার।
১৯৯২ সালে নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে, বসনিয়া-হারজেগোভেনিয়ার নাম। ক্রোয়াট, বসনিয়ান ও সার্ব যুদ্ধ লিপ্ত হন। এটা ছিল জাতিগত যুদ্ধ। এখানেও শেষ অব্দি ন্যাটো জড়িয়ে যায়। এরপর বেশ কিছু যুদ্ধ হয়েছে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু তা উল্লেখ করছি না সংক্ষিপ্ত করার জন্য।
নাইন-ইলেভেন। আমেরিকার গগণচুম্বি টুইন টাওয়ার চুরমার। বেঁধে গেল আফগান যুদ্ধ। এটি একটি সশস্ত্র সংঘাত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক সামরিক জোট আফগানিস্তানে আক্রমণ শুরু করে। বহু নিরীহ মানুষ নিহত হন। তখন আমেরিকার পছন্দের পুতুল ছিল হামিদ কারঝাই। তিনি নাকি সব সময় পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন আফগান রাষ্ট্রপতি। তার হাত ধরে বহু মূল্যবান খনিজ সম্পদক নাকি নিয়ে যায় আমেরিকা।
এছাড়া পাশের দেশ মিয়ানমারে (অবশ্য ইউএসএ অভিহিত করে বার্মা বলে) জাতিগত সংঘাত চলছে। লিংকটি দেখুন (https://www.state.gov/briefings/department-press-briefing-april-11-2024/#post-551862-BURMA)। এই লিংকে এখনও তারা মিয়ানমারকে বার্মা নামেই চেনে। এই মায়ানমারে এখন গণতন্ত্র নেই, সেখানে বহু বছর সামরিক জান্তা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠান করছে। সেনা কর্তারা দেশ শাসন করছে। যা কিনা বিশ্বরাজনীতিতে বেমানান। রাজনীতি হতে হবে গণতান্ত্রিক। দেশ হতে হবে গণতান্ত্রিক। মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করে বরং সংঘাত ঝিইয়ে রাখা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদেরও পক্ষ নিচ্ছে আমেরিকা। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না আমেরিকা। বাংলাদেশ কূটনৈতিক চ্যানেলে বহুবার বলেছে আমেরিকাকে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কারণ হয়তো, রোহিঙ্গা দিয়ে আমেরিকা বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চায়।
ওইসব যুদ্ধের বিষয়ে পক্ষপাতমূলক গণমাধ্যম থেকে আমি তথ্য পেয়ে থাকি। শুনে থাকি। কারণ ঐ যে বলেছিলাম, আমি খুব ছোট্টকাল থেকে খবর শুনি। জীবিতকালে এইসব খবর শুনে-পড়ে মনে হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ম্পক আছে যুদ্ধগুলোতে। আমার জীব্বদশায় যুদ্ধের এই সব কাহিনী শুনেছি-পড়েছি। আমার চেতনা হওয়ার আগে যেসব ঘটনা বা যুদ্ধ ঘটেছে, সেই সব যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বইয়ের পাতা থেকে নেওয়া নয়; অর্থাৎ মৃত ইতিহাস থেকে জানা নয়। আমি সেই মৃত ইতিহাসে লেখা যুদ্ধের কাহিনী বলছি না।
আমার তো মনে হয়েছে, রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন হত্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জড়িত। গালফ ওয়্যারে মার্কিন দায়িত্বপ্রাপ্তদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিৎ, যেন তারা বিশ্বমাঝে চলাচল না করতে পারেন। নিষেধাজ্ঞা দেবে কে বা কোন সংস্থা? জাতিসংঘ দিতে পারে। তারা তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তলপিবাহক। তার মানে হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বমাতব্বর। তাকে কিছু বলা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপরাধ করলে সাতখুন মাফ।… এটা একটা গ্রহের বিচার ব্যবস্থা হতে পারে না। এই গ্রহে যেই অপরাধ করবেন, তাকে বিচারের আওতায় আসতে হবে।
যেমন- বাংলাদেশের সাবেক জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদি আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যে হামাস ও ইসরায়েলের কর্তাব্যক্তিদের ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করল, সেটা মানতে হবে।
আমাদের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আমমেদ নাকি দেশের গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হতে সহায়তা করেছে, ভালো কথা। তাহলে আমেরিকা যখন আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধ করেছিল, তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল? পারেনি। বরং সেই সব দেশের মানুষকে হত্যা করেছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী। এর বিচার হওয়া দরকার। কিন্তু বিচার করার কেউ নেই। এটাই বিশ্বব্যবস্থার বড় অস্থির দিক, কাঠখোট্টা দিক।
পদ্মাসেতুর বিষয়ে আমেরিকা কথা বলতে চেয়েছিল একদা। তাদের আঙুলের ইশারায় চালিত বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ বলতে চেয়েছিল পদ্মাসেতু নির্মাণে দুর্নীতি হচ্ছে, তবে ওইসব সংস্থার অভিযোগ হালে পানি পাইনি। বরং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নিরন্তর নির্মাণশৈলী হিসেবে পদ্মাসেতু বানিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববাসীকে। এই পদ্মাসেতু দক্ষিণবঙ্গের মানুষের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।
অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, তার আগেই সুযোগ্য সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সুবিবেচনা প্রসূত হয়নি। বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আছে নাকি আমেরিকার কাছে, হাজির করুক। তারা প্রমাণ করুক, আমি মনে করি তারা তা পারবে না।
বাংলাদেশের সংবিধান আছে। সংবিধান মেনে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের জন্য আইন আছে, আছে বিধিমালা। এসবই করা হয়েছে গণতান্ত্রিক উপায়ে। সেই সব আইন-বিধিমালা মেনেই দেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। তাহলে জেনারেল আজিজ আহমেদ কিভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করলেন? আমি মনে করি, তিনি সংবিধান সমুন্নত রাখতে আইন ও বিধি মোতাবেক কাজ করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন আজিজ আহমেদ। ওই নির্বাচনে বরং বিএনপি সহিংসতা করেছিল। মানুষ হত্যা করেছিল। সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও ঢাকায় ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করেন বিএনপির নেতারা। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরে ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন।
এসব কথা বাদ দিয়ে ফিরে আসি গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে কোনো আইনই ছিল না, সেই আইন বিরাজমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই গেজেটে পরিণত হয়েছে। এর ফলে অনুসন্ধান কমিটি গঠন হয়। অনুসন্ধ্যান কমিটি কয়েকজনের নাম পাঠিয়ে দেন রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি সেই নাম থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ দেন। এসবই হচ্ছে আইনের ক্ষমতাবলে। মার্কিনীদের আইন আছে। আমাদেরও আইন আছে। সেই আইনে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়, যেটা আগেই বলেছি।
ফরেন অপারশেনস অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েসনস আইনের ৭০৩১ (সি) ধারার আওতায় আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও অকাট্য প্রমাণ নেই এখনও আমেরিকার হাতে। যদি থাকে তা প্রকাশ করুক। আমরা আশা করতেই পারি, এই আইন পৃথিবীর অন্যদের ওপর প্রয়োগ করতে হবে, যারা এর আওতায় পড়েন। এবং তা ফলাও করে প্রচার করতে হবে কথিত গণমাধ্যমে।
লেখক: অজিত কুমার মহলদার,
প্রাক্তন নির্বাহী সদস্য,
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন।