ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের বিখ্যাত একটি উক্তি রয়েছে যা হলো, আমি তোমার কথার সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে দিবো। এই উক্তি তিনি করেছিলেন ফরাসি তথা সমগ্র বিশ্বের মানুষের বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে। তবে সেটি আর হলো কোথায়। প্রায় সময়ে শোনা যাচ্ছে লেখকদের কন্ঠরোধ করার কথা, স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশে বাধা, এমনকি মত বিরোধী হলেই করা হচ্ছে নিষিদ্ধ। আদর্শগত মিল না হলেই নিষিদ্ধ করে বাজার কিংবা মেলার প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বই। যার সবশেষ উদাহরণ অমর একুশে বই মেলা ২০২৫।
বিতর্কিত লেখক তসলিমা নাসরিনের বই রাখার অভিযোগে বিক্ষুদ্ধ জনতার রোষানলে পড়ে এবারের বই মেলায় অংশ নেওয়া সব্যসাচী প্রকাশনীর একটি স্টল। সে সময় হেনস্তার শিকার হোন প্রকাশনিতে থাকা শতাব্দী ভব নামে একজন লেখকও। বিক্ষুদ্ধ লোকের রোষানলে এক সময় প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হয় সে লেখককে। বই মেলার এমন অপ্রীতিকর ঘটনার পুরোটা জুড়েই আলোচনায় তসলিমা নাসরিন। কে এই বিতর্কিত লেখক তাসলিমা? কেন বা এত আলোচানায় থাকেন তিনি?
কোন কিছু লিখলেই আলোচিত এবং বিতর্কের কারণ হওয়া খুব কম লেখকের মধ্যে তসলিমা নাসরিন একজন। তাঁর বিতর্কিত লেখনি একদিকে যেমন গায়ে কাঁটা দিবে অন্যদিকে বাস্তব কিছু চরিত্র ফুটিয়ে তুলবে। পাশাপাশি দেখা মিলবে প্রচলিত সমাজ কাঠোমোর বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তিনি মূলত বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে একজন উদীয়মান কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। তার লেখার মূল প্রতিপাদ্য লিঙ্গসমতা, মুক্তচিন্তা, নাস্তিক্যবাদ এবং ধর্মবিরোধীতা। ধর্মবিরোধীতা এবং নাস্তিক্যবাদ প্রচার করায় ইসলামপন্থীদের রোষানলে বারবার পড়তে হয়েছিলো তসলিমা নাসরিনকে। এরপরেও নিজের একাগ্রতা থেকে সরে আসেননি তিনি।
১৯৯৪ সালে ইংরেজি পত্রিকা দ্যা স্টেটম্যানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ধর্মীয় শরিয়া আইন বাতিল এবং মুসলিমদের পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআন সংশোধনের ইচ্ছে প্রকাশ করেন তিনি। এরপরই তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ্যে আসতে শুরু হয়। ইসলামপন্থীরা তার ফাঁসির দাবি জানাতে শুরু করেন। সারাদেশে একযোগে প্রায় তিন লাখ মুসলিমের একটি জমায়েতে তসলিমা নাসরিনকে ইসলাম অবমাননাকারী হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং তার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ডাকা হয় ধর্মঘট। মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত হানায় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। জামিন অযোগ্য মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয় তার বিরুদ্ধে। প্রায় দুইমাস আত্মগোপনে থাকার পর আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের সহযোগীতায় জামিন মঞ্জুর করে দেশ থেকে পলায়ন করেন তসলিমা।
একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে বিতর্কিত তসলিমা নাসরিনের প্রণয়ের গুঞ্জন রয়েছে। তবে বৈবাহিক জীবন শুরু করেছিলেন আরেক সাহিত্যিক রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে। নিজের লেখা প্রকাশের স্বার্থে তসলিমা প্রেমে পড়েছিলেন বহুবার। বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিজের প্রেমের বিষয়ে এভাবেই বলতেন তিনি। তসলিমা নাসরিনের প্রথম নিষিদ্ধ বইয়ের নাম “লজ্জা” যেটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯৩ সালে। এরপর আমার “মেয়ে বেলা” “উতল হাওয়া” “ক” “সে সব অন্ধকার” সব বইতে ইসলাম বিদ্বেষ এবং প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) সম্পর্কে কূটক্তি থাকার অভিযোগে বইগুলো সব নিষিদ্ধ করা হয়। “আমার মেয়ে বেলা” বইটি প্রকাশিত হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে। এন্টি-ইসলামিক বিষয় থাকায় সে সময় বইটি নিষিদ্ধ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
বাংলাদেশ থেকে ১৯৯৪ সালে নির্বাসিত হওয়ার পর দীর্ঘ অনেক বছর বসবাস করেছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এরপর ইউরোপ ছেড়ে ২০০৪ সালে পাড়ি জমান ভারতে। ভারতেও একাধিকবার নিজের আবাসন পরিবর্তন করতে হয় তসলিমা নাসরিনকে। তবে সবশেষ তথ্যমতে ২০১১ সাল থেকেই ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে বসবাস করে আসছেন তসলিমা। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তার স্থায়ী থাকার কোন নির্দেশনা দিয়েছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।