কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমন্বয়ককারী ফরহাদ কাউসারকে ছাত্রলীগ কর্তৃক মারধরের ঘটনায় উত্তপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা গিয়েছে মতানৈক্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মারধরকারীদের খুজতে লাঠি নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে।
এছাড়া ফরহাদ কাউসারকে মারধরের ঘটনায় নুসরাত সুরভী নামক এক ছাত্রলীগ কর্মী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
সোমবার (১৫ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৮ টায় নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হলের সামনে ফরহাদকে মারধর এবং হাত থেকে মোবাইল নিয়ে চেক করার ঘটনা ঘটে।
মারধরের ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম ফরহাদ কাউসার। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী। এছাড়া মারধরকারী হিসেবে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হলেন- শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক রবিন দাশ, উপ-নাট্য ও বিতর্ক বিষয়ক সম্পাদক রবিউল আলম রিয়াজ, ছাত্রলীগ কর্মী আক্তারুজ্জামান পাভেল, ব্যবসা শিক্ষা অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুর রহমান রাফি, ছাত্রলীগ কর্মী জুনায়েদ লামিম, অর্ণব সিংহ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি আসিফ এনতাজ রাব্বি। এদের অনেকেই শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহর গ্রুপের কর্মী। এছাড়া মারধরের সময় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও আগামী কমিটির পদপ্রত্যাশী মেজবাহউল হল শান্ত উপস্থিত ছিলেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফরহাদ কাউসার সহ আরো কয়েকজনকে ক্যাম্পাস সংলগ্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড় করিয়ে মোবাইল চেক করে এবং মারধর করে। ফরহাদ কাউসার মারধরের শিকার হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হলে আসলে শাখা ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতাকর্মীরাও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে উত্তেজিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু হল থেকে বেরিয়ে মারধরকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস গেটে যায় মারার উদ্দেশ্যে। মারধরকারীদের না পেয়ে উত্তেজিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দত্ত হলের দিকে এগুতে থাকে। তখন শাখা ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীরা উত্তেজিত নেতাকর্মীদের থামাতে চেষ্টা করেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি ও বঙ্গবন্ধু হল প্রশাসন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের থামানোর চেষ্টা করেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ফরহাদ কাউসার বলেন, আমি রাতের বাসে শহর থেকে টিউশন করে এসে ক্যাম্পাস গেইট নামি। এরপর আমাকে কয়েকজন ডেকে নিয়ে যান। তারা আমার ফোন কেঁড়ে নিয়ে লক খুলতে বলেন এবং জানতে চান আমি কোটা বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত আছি কিনা। তারা আমার ফোন চেক করতে থাকা অবস্থায় রবিন দাশ প্রথমে আমাকে মারধর করতে শুরু করেন। এরপর পাভেল, রাফি, শান্ত, রিয়াজ, রাব্বি আমাকে মারধর করেন।
অভিযুক্তদের একাধিক কল দিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ছাত্রলীগের আগামী কমিটিতে পদপ্রত্যাশী নেতা এনায়েত উল্লাহ এই মারধরের বিষয়ে বলেন, ‘আমি যতটুকু শুনেছি, কালকে রাজাকার স্লোগানের পর ছাত্রলীগ তাদের প্রতিহত করে। আজকেও ওদের সাথে কথা-কাটাকাটির হয়েছে। এক পর্যায়ে ওদের একজনের সাথে মারামারি হয়। আমরা তিন হলের সবাই বিষয়টি নিয়ে অবগত রয়েছি। সকলে বসে একটা সমাধানে আসব।’
কুবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠিক সম্পাদক আবু সাদাত সায়েম জানান, ‘এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেব, যাতে কেউ বঙ্গবন্ধু হলের শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার সাহস না পায়।’
এই বিষয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুবি শাখার সমন্বয়কদের একজন মো. সাকিব হোসাইন বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবেই আজকের সকল কর্মসূচি পালন করেছিলাম। কিন্তু এই যে হামলা সেটিতে আমরা মর্মাহত। পাশাপাশি তার ফোন চেক করা একপ্রকার সাংবিধানিক অধিকার লঙ্গন করা হয়েছে। আমরা এর যথাযথ বিচার চাই।’
এর বিপরীতে উনাদের কর্মসূচির বিষয় তিনি বলেন, ‘আমরা প্রশাসন বরাবর অভিযোগ দিবো। তারা যদি যথাযথ বিচার না করেন তাহলে আমরা আদালত পর্যন্ত যাবো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শামসুজ্জামান মিলকী বলেন, ‘ আমি খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। তারপর প্রক্টরিয়াল বডির সাথে মিলে ছাত্রদের থামানোর চেষ্টা করি। আমরা ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। তবে এখন পর্যন্ত আমরা এই বিষয়ে আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। আমরা ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করছি।’
এই ঘটনায় পদত্যাগ এক ছাত্রলীগ নেত্রীর:
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ফরহাদ কাউসারের উপর ছাত্রলীগ কতৃক মারধরের অভিযোগ উঠায় এই ঘটনার প্রতি নিন্দা জানিয়ে নুসরাত জাহান সৌরভী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। নুসরাত সুরভীর সাথে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের উপ-নাট্য ও বিতর্ক বিষয়ক সম্পাদক রবিউল আলম রিয়াজের বিয়ে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগেই। তবুও তারা দুইজন ছাত্রলীগের বিভিন্ন পোস্টে ছিলেন। এছাড়া
নুসরাত জাহান সৌরভী প্রথম থেকেই কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
ছাত্রলীগের পদ থেকে পদত্যাগের বিষয়টি নুসরাত জাহান সৌরভী সোমবার (১৫ জুলাই) রাত সাড়ে নয়টায় তার নিজ ফেসবুক প্রফাইলে পোস্ট করে নিশ্চিত করেন।
ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, “নওয়াব ফয়জুন্নেছা হল,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ এর সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে নিজ সেচ্ছায় পদত্যাগ করলাম। আমি লজ্জিত যে আমি এমন একটা সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম।”
পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে নুসরাত জাহান সৌরভী বলেন, “আপনিও মানুষ আমিও মানুষ, আপনিও জানেন দেশে কি হচ্ছে। সেই মানবিক দিক বিবেচনা করে আমি শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছি।”