সহশিক্ষা কার্যক্রম হলো শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত উন্নয়নমূলক কার্যক্রম যা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠ্যক্রমের অতিরিক্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকে। একজন শিক্ষার্থী তার পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকে।
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের সমিতি থাকতে পারে যেমন শিক্ষক সমিতি, কর্মকর্তা সমিতি, কর্মচারী সমিতি। এ সমিতি গুলো শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক পরিচালিত হয়। তবে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত একটি সমিতি দেখা যায় যেটা সাংবাদিক সমিতি। বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন যারা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ক্যাম্পাস প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত থাকে। অন্যদিকে ক্লাব একটি সাধারণ উদ্দেশ্য বা আগ্রহের লোকদের একটি সংগঠন যারা বিভিন্ন সামাজিক, বিনোদনমূলক ও আত্মোন্নয়নমূলক ক্রিয়াকলাপে অংশ নেয়। যেমন বলা যায় স্পোর্টস ক্লাব, বিতর্ক ক্লাব, আর্ট ক্লাব, সাংস্কৃতিক ক্লাব ইত্যাদি। এই ক্লাবগুলো শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট নিয়েও কাজ করতে পারে।
প্রতিটি সংগঠনের কাজের বিভিন্ন ভাগ থাকে। সংগঠনগুলো সাধারণত ম্যানেজমেন্ট, লজিস্টিক্স, যোগাযোগ, এডমিন, জনসংযোগ, গণমাধ্যম ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে দেখা যায় ক্লাবগুলোতে প্রতিটি বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা লোক নিয়োগ করা থাকে। কিন্তু একটি সমিতির প্রত্যেকটি সদস্যকে প্রায় সবগুলো দায়িত্ব পালন করতে হয়। সেক্ষেত্রে একজন সমিতির সদস্যের কাজ অনেকাংশে বেশি এবং বৈচিত্র্যময় যা একটি সমিতি ও ক্লাবকে আলাদা করে। ক্লাবে সাধারণত ইভেন্টভিত্তিক কার্যক্রম চলে। ক্লাবসমূহের কাজগুলো এককালীন হলেও একটি সমিতির কাজ প্রায় বারো মাস জুড়ে থাকে। কোন প্রতিষ্ঠানের একটি সমিতি ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ প্রশাসনের সকল বিভাগ নিয়ে কাজ করে। কিন্তু একটি ক্লাব সাধারণত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে। ক্যাম্পাসে ক্লাবের সদস্যদের আলাদা কোন পরিচয় থাকে না। কিন্তু একটি সমিতির প্রতিটি সদস্যের আলাদা একটি পরিচয় থাকে ‘সাংবাদিক’।
একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে তার সামনে উন্মুক্ত হয় নিজেকে উপস্থাপন করার, নিজের প্রতিভাকে মেলে ধরার, নিজের সুপ্ত প্রতিভাকে খুঁজে তা শানিত করার সুযোগ। সহশিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা বেশ কিছু সফট স্কিল আয়ত্তে আনার সুযোগ পায় যা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে বেশ সহায়ক হয়। এদিক থেকে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা একটা চমৎকার সহশিক্ষা কার্যক্রম।
সাংবাদিকতা এমন একটা কাজ, যেখানে নানা শ্রেণির, নানা পেশার মানুষের সঙ্গে মিশতে হয় ও কথা বলতে হয়। একজন ক্যাম্পাস সাংবাদিকের ক্ষেত্রে বিষয়টা একই। তাকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরনের এবং চিন্তাভাবনার লোকজনের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। কোন পক্ষের বিপরীতে সংবাদ প্রকাশ করা হলে সাংবাদিকের উপর চাপ আসতে পারে যা হতে পারে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন অথবা শিক্ষকদের দ্বারা। এসব পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে কাজ করে একজন ক্যাম্পাস সাংবাদিক চাপ সামলাতে শিখেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের দায়িত্ব পালন করতে শিখেন। একটি ঘটনার সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে ঐ ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগত থাকতে হয় যাতে ঐ সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। যার জন্যে সবসময় সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে সজাগ থাকতে হয়।
ক্যাম্পাস সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গি একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর থেকে ভিন্ন হয়। সাংবাদিকদের অনেক ঘটনার পেছনের ঘটনা তুলে আনতে হয়। ক্যাম্পাসে কখন কোথায় কি হচ্ছে এ সম্পর্কে খবর রাখতে হয়। কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে হয়।
অনেক বাস্তবমুখী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় সাংবাদিকদের, যা তাঁদের বাস্তবভিত্তিক চিন্তা বিকাশে সহায়তা করে। তাছাড়া একটি সংগঠনের সাথে কাজ করার মাধ্যমে নিজে অর্জন করেন নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতা।
একজন ক্যাম্পাস সাংবাদিকের যোগাযোগ ওই ক্যাম্পাসের প্রায় সকল ধরনের লোকদের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট থেকে বড় যে কোন পদের মানুষই চিনেন একজন ক্যাম্পাস সাংবাদিককে। প্রশাসনিক পদের ব্যক্তিরা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা শিক্ষক-স্কলারদের সঙ্গেও গড়ে ওঠে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের সম্পর্ক। অর্থাৎ নেটওয়ার্কিংয়ের ভালো একটি সুযোগ তৈরি হয়। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে এসব নেটওয়ার্কিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে মুদ্রোর উলটো পিঠও রয়েছে। অন্যান্য ক্লাবিং এর তুলনায় ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় ঝুঁকি তুলনামূলক বেশিই। কিছু সত্য খবর প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলজনক হলেও নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির জন্য হয়ে ওঠে অমঙ্গলজনক। বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের পরও সাংবাদিকরা দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের নজরে চক্ষুশূল হয়ে উঠছেন। ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের ওপর আঘাত হানা হচ্ছে। আবার সংবাদ প্রকাশের জেরে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন অনেক সাংবাদিক। শুধু তা–ই নয়, পড়তে হয় প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের রোষানলে। এভাবে ব্যক্তিস্বার্থে বলি হন অনেক ক্যাম্পাস সাংবাদিক। শিক্ষাজীবনে নেমে আসে নানা জটিলতা।
ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করলে তাদের মতামত জানা যায়। বুটেক্স বিজনেস ক্লাবের এক্সিকিউটিভ মেম্বার ও বাঁধনের (বুটেক্স ইউনিট) সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আকন্দ এ সম্পর্কে বলেন, ক্লাবিং এর উপকারিতা গুলো যদি বলতে যাই ক্লাবিং আমাদের স্কিল ডেভেলপ করতে সাহায্য করে এবং আমাদের সৃজনশীলতাকে বৃদ্ধি করে। আমি নিজে বুটেক্সের দুটি ক্লাবের সাথে জড়িত, বাঁধন বুটেক্স ইউনিট এবং বুটেক্স বিজনেস ক্লাব। বাঁধন একটি স্বেচ্ছাসেবামুলক সংগঠন যা প্রয়োজনের সময় রক্ত সংগ্রহ করার মাধ্যমে সমাজসেবামূলক কার্যক্রম করে থাকে। এখানে কাজ করার মাধ্যমে আমি সহযোগিতামূলক মনোভাব বিকাশ করতে পারছি। অন্যদিকে বুটেক্স বিজনেস ক্লাব একটি প্রফেশনাল ক্লাব। এই ক্লাব আমাকে লিডারশিপ, কমিউনিকেশন স্কিল ও বিভিন্ন ধরনের সফট স্কিল ডেভেলপ করতে সাহায্য করছে।
অন্যদিকে সাংবাদিক সমিতি বেশ উপকারী। অনেক আগাম খবর এটার মাধ্যমে পাওয়া যায়। ভালো-খারাপ সব ধরনের খবর এরা তুলে ধরে যা অবশ্যই একটি পজিটিভ দিক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করতে সাংবাদিক সমিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বুটেক্স সাংবাদিক সমিতির সদস্য আলভি আহমেদ বলেন, আমার মতে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা অন্যতম একটি সেরা শিক্ষা কার্যক্রম, কেননা এর মধ্যে অনেক কিছু জানার শিখারও বুঝার রয়েছে, পাশাপাশি অনেকগুলো দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটে। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট হিসেবে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। মূলত সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা কেননা যতই সত্য সংবাদ প্রকাশ করা হোক না কেন সেটা কখনো কখনো কারো বিপক্ষে চলে যায়। রেখেছে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয়। ক্যাম্পাসের সাংবাদিকতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এসব বাধা অতিক্রম করতে শিখে যা পরবর্তী জীবনে তাদের সহায়তা করে। এছাড়া ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার মাধ্যমে কথা বলার দক্ষতা যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। হিরো ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা একজন শিক্ষার্থীকে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে শেখায়, তার চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি ঘটে।
হাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক রাফিউল হুদা বলেন, ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সহায়ক। ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে একটি অন্যতম সেরা সহশিক্ষা কার্যক্রম, কারণ এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানাবিধ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা শিক্ষার্থীদের লেখার দক্ষতা, তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনা এবং সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে। একই সঙ্গে, এটি বাস্তব সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ দেয়, যা ভবিষ্যতে পেশাগত জীবনে অনেক কাজে লাগে। এছাড়া ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের গুণাবলি, সময় ব্যবস্থাপনা এবং দলের সাথে কাজ করার দক্ষতা বাড়ায়। এটি শিক্ষার্থীদের গণমাধ্যম সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয় এবং তাদের নিজস্ব মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ও দায়িত্বের গুরুত্ব বোঝায়।
পরিশেষে, ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা গতানুগতিক সহশিক্ষা কার্যক্রমের চেয়েও বেশি কিছু, এটি একটি রূপান্তরমূলক যাত্রা যা ব্যক্তি জীবনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।