মোহাম্মদ নিলয়,
ক্রীড়া প্রতিবেদক
ক্রিকেট এমন এক খেলা, যেখানে প্রতিদিন কেউ না কেউ রেকর্ড গড়েন, কেউ না কেউ ভাঙেন। কিন্তু কখনও কখনও এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং ইতিহাস হয়ে যায়। ২০২৫ সালের আইপিএলে এমনই এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকল ক্রিকেট বিশ্ব। রাজস্থান রয়্যালস বনাম গুজরাট টাইটানসের ম্যাচে উঠে এল এক বিস্ময় বালক যার নাম—বৈভব সূর্যবংশী। বয়স মাত্র ১৪ বছর, আর এই বয়সেই তিনি গড়ে ফেললেন এমন এক রেকর্ড, যার ব্যাটিং তান্ডবে স্তব্ধ পুরো ক্রিকেট দুনিয়া।
গুজরাট টাইটানসের বিপক্ষে ব্যাট হাতে নেমে মাত্র ৩৫ বলে শতরান। পুরো ইনিংসে ৩৮ বলে ১০১ রান, যেখানে ছিল ১১টি ছক্কা আর ৭টি চার। কোনো ঝুঁকিপূর্ণ শট নয়, শুধু নিখুঁত ক্রিকেটীয় ব্যাটিং, টেকনিক, টাইমিং আর সাহসের মিশেল। ব্যাটিং দেখে মনে হবে তরুণ কোন ক্রিকেটার নয় বরং বাইশগজে দূতি ছড়াচ্ছেন অভিজ্ঞ কোন ক্রিকেটার।
বৈভবের জন্ম বিহারের সমস্তিপুর জেলার এক সাধারণ পরিবারে। বাবা একজন স্কুল শিক্ষক, মা গৃহিণী। আর পাঁচটা বাচ্চার মতো তারও ছোটবেলায় খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল, কিন্তু ক্রিকেটে ছিল এক অদ্ভুত টান। গলির ম্যাচ হোক বা স্কুল টুর্নামেন্ট—সব জায়গাতেই সে ছিল সবার চেয়ে আলাদা। কোনও কোচিং ছিল না, ছিল না পেশাদার প্রশিক্ষণ। কিন্তু ছিল চোখে আগুন, আর ব্যাটে জাদু ও দৃঢ় মনোবল এবং প্রবল আত্মবিশ্বাস।
১১ বছর বয়সে প্রথম সুযোগ পান রাজ্যের অনূর্ধ্ব-১৪ দলে। সেখানে এক ম্যাচে মাত্র ৪৫ বলে ৯৮ রান করে নজর কাড়েন। এর এক বছরের মধ্যেই ডাক পড়ে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। সেখানেও বাজিমাত। অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিরুদ্ধে এক ম্যাচে ৫৮ বলে শতরান করে সবার দৃষ্টি কাড়েন। তখন থেকেই তার নাম ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইন্ডিয়ায়। ভাগ্যক্রমে আইপিএলের ২০২৫ মৌসুমের আগে রাজস্থান রয়্যালসের একটি ট্রায়ালে অংশ নেন বৈভব। সেখানে এক ওভারে তিনটি ছক্কা হাঁকিয়ে সরাসরি মুগ্ধ করেন দলের কোচিং স্টাফকে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়ও, যিনি বর্তমানে দলটির মেন্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যক্তিগত ভাবে দ্রাবিড়ের চাওয়াতেই আইপিএল নিলামে ১.১ কোটি টাকায় বৈভবকে দলে নেয় রাজস্থান রয়্যালস।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল, “১৪ বছরের এক তরুণ খেলবে আইপিএল?” কিন্তু সেই প্রশ্নের জবাব বৈভব দিয়েছেন ব্যাট দিয়ে। শুধু খেলার সুযোগ পেয়ে সন্তুষ্ট থাকেননি ব্যাট হাতে রেকর্ডগড়া শতক হাঁকিয়ে দিয়েছেন তার জবাবও। রাজস্থানের কোচ দ্রাবিড় বৈভবকে নিয়ে বলেন, “ওর চোখে যে আত্মবিশ্বাস, তা অনেক সিনিয়র খেলোয়াড়ের মধ্যেও দেখা যায় না। বৈভব ক্রিকেটকে বুঝে খেলতে জানে। বয়স তার প্রতিবন্ধক নয়, বরং এটি তার মূল অস্ত্র।” ভারতীয় এই লেজেন্ডের প্রশংসা বলে দেয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নবাবের বেশেই আত্মপ্রকাশ করবে তরুণ এই ক্রিকেটার।
বৈভব একজন লেফট-হ্যান্ড ব্যাটসম্যান। ওর ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে বড় গুণ হলো পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার ক্ষমতা। সে শুধু বড় শট খেলতে জানে না, সে জানে কখন গ্যাপ খুঁজে সিঙ্গেল নিতে হবে, কখন চাপ এড়াতে স্ট্রাইক ঘোরাতে হবে। ওর টাইমিং, ফুটওয়ার্ক, শট সিলেকশন—সবই অবাক করার মতো পরিণত। অনেকেই বলছে, ও যেন বিরাট কোহলি আর সূর্যকুমার যাদবের মিশ্রণ! মাঠের বাইরে একদম সাধারণ, সংযত আর শান্ত স্বভাবের। সে আজও স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে গেম খেলার চেয়ে পছন্দ করে পুরনো ক্রিকেট ম্যাচ দেখা। আইডল হিসেবে দেখে বিরাট কোহলিকে, কিন্তু মানসিক প্রস্তুতির দিক থেকে ও অনেকটা ধোনির মতো—শান্ত, স্থির। অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়ে ম্যাচ শেষে বৈভব বলেন, “আমি আমার কাজটা করে গেছি। আমি জানি আমার দায়িত্ব কী। আমি চাই ভারতের হয়ে খেলতে, বিশ্বকাপে ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে।”
আজ যখন ক্রিকেটবিশ্ব তার প্রশংসায় মুখর, তখন মনে হচ্ছে—এই কিশোরই হয়তো আগামী দশকের ভারতীয় ক্রিকেটের চালিকাশক্তি হতে চলেছে। অনেক সময় আমরা বলি, “প্রতিভা থাকলেই সব সম্ভব নয়”, কিন্তু বৈভব দেখাচ্ছে, প্রতিভা, পরিশ্রম আর সঠিক প্ল্যাটফর্ম এক হলে সবই সম্ভব।
বৈভব সূর্যবংশী এখন আর শুধু একটি নাম নয়—এটা ক্রিকেটীয় অনুপ্রেরণার জীবন্ত উদাহরণ। একটা প্রজন্মের কান্ডারি , যারা ভয় না পেয়ে এগিয়ে যেতে চায়।একটা স্বপ্নের প্রতীক, যা গ্রামের মাঠ থেকেও উঁকি দিতে পারে আইপিএলের আলোঝলমলে স্টেডিয়ামে। হয়তো একদিন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠবে এই তরুণ তুর্কির মুখেই। নীল জার্সি গায়ে একের পর এক রেকর্ড গড়ে মনে করিয়ে দিবেন ১৪ বছর বয়সে রশিন খান, ইসান শর্মাদের শাসন করার গল্প।