ছাত্র-জনতার দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে নতুন ভোরের সূর্য দেখেছে আপামর জনসাধারণ। এই নতুন ভোরের সূর্যের আলোতে রাষ্ট্রের সমস্ত কালোছায়া দূর করার উদ্যোগে মেতেছে দেশবাসী। নানা অনিয়ম, দূর্নীতি, মিথ্যাচার ও অনাচারে ডুবে থাকা রাষ্ট্রকে মেরামত ও সংস্কারের প্রত্যয়ে নিবেদিত জনতা।
রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ঢেলে সাজাতে চাইছে শিক্ষার্থীরা। তারা চায় বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে না কোনো বৈষম্য, থাকবে না কোনো বিভেদ, থাকবে না শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভীতিকর নোংরা রাজনীতি। যেখানে চর্চা হবে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক, যেখানে চর্চা হবে সাম্যের গান, যেখানে তৈরি হবে নীতিগত আদর্শ। যে আদর্শের তেজ সারা বাংলায় ছেয়ে যাবে, যে আদর্শে বলীয়ান হয়ে নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা প্রণয়ন হবে। এসব নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেছেন রকি উল হাসান। তিনি জানাবেন শিক্ষার্থীদের কথা…
১. ‘শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ’ :
“শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি কেবল দালিলিকভাবে বন্ধ না হয়ে বাস্তবিকভাবে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ‘ছাত্র-শিক্ষক পরিষদ’ নামক একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গঠিত হয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করা যেতে পারে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকবে বলে বিশ্বাস করি। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত; পূর্বে যেটা বরাবরই উপেক্ষিত ছিলো।”
আকরাম হোসেন, বাংলা বিভাগ।
২. ‘শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস চাই’
“আমি চাই আমার ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীবান্ধব হয়ে উঠুক। যেখানে কোনো দলেরই লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থাকবে না, কোনো একটি দল বা সমষ্টির ব্যক্তিদের হাতে ক্যাম্পাস জিম্মি হয়ে থাকবে না। সকলের জন্য ক্যাম্পাস হবে নিরাপদ একটি জায়গা। তবে ভবিষ্যত নেতৃত্ব বিবেচনায় ছাত্রসংসদ থাকতে পারে। শিক্ষকরাও চাটুকার না হয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব হবে। বাস্তবসম্মত শিক্ষা দিবে এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য রিসার্চে শিক্ষকরা সহযোগীতা করবে এবং উৎসাহদাতা হবে। ক্ষতি পূরণে সেমিস্টারের সময়সীমা কমিয়ে আনবে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অ্যাকাডেমিক জীবনই সব না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি নেই। টিএসসি থাকলে আমাদের মধ্যে জ্ঞান আদান-প্রদানের একটা প্ল্যাটফর্ম হতো। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিএসসির অধীনে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা কোর্স করা যায়। যা শিক্ষার্থীদের পরবর্তী জীবনে কাজে লাগে। আমাদের এখানে সেরকম কোন ব্যবস্থা নেই। আইকিউএসি নামক একটা জিনিস ক্যাম্পাসে আছে কিন্তু শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াতে কোন কাজ করতে দেখলাম না তাদের। আমি চাই, ক্যাম্পাস থেকেই যেন শিক্ষার্থীরা দক্ষতা উন্নয়ন করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হোক। সর্বোপরি আমি চাই, ক্যাম্পাস হোক শিক্ষার্থীবান্ধব।’
রনি আহমেদ, গণিত বিভাগ
৩. ‘সেমিস্টারের সময়সীমা কমানো ও প্রশাসনিক কাজে গতিশীলতা বৃদ্ধি’
করোনা এবং তার পরবর্তী সময়ের নানা প্রেক্ষাপটের ফলে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠতে প্রয়োজনে সেমিস্টারের সময়সীমা কমানো উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এবং বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে যে সংকট তৈরি হয়েছে দ্রুত সময়ের তা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করে একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কাজে গতি ফেরাতে হবে। এছাড়া আমাদের নতুন ক্যাম্পাসের কাজ যেন দ্রুত শেষ হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ক্যাম্পাসে সকল শিক্ষার্থীরা যাতে স্বাধীন ভাবে চলতে পারে, নিজ নিজ জায়গা থেকে যাতে মৌলিক অধিকারগুলো চর্চা করতে পারে তা নিশ্চিত করাও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থসেবার মান উন্নত করা উচিত প্রসাশনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার খাবার মান উন্নত করা এবং হলগুলোতে ভর্তুকি প্রদান করা। সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন খেলাধুলা আয়োজন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গসংগঠনগুলোর গতিশীলতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং পরিবহন পুলে আরো বাস যুক্ত করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যাতায়াত ভোগান্তি কমানো।”
শিশির ইসলাম, আইন বিভাগ।
৪. ‘ছাত্র সাংসদ গঠন ও গবেষণার পরিবেশ তৈরি’
শিক্ষার্থীদের দাবি প্রসাশনের কাছে পৌঁছানোর জন্য ছাত্র সংসদ থাকা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই শীঘ্রই ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ গঠনের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া উচিত প্রশাসনকে। গণঅভ্যুত্থান পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির কারণে অনেক শিক্ষার্থীকে রাজনীতি করতে হয়েছে। ফলে পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসব শিক্ষার্থীদের। এবার সময় নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়কে সাজানোর। সকল রাজনীতি বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকার মাধ্যমে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ পায় সেদিকে নজর দিতে হবে। এছাড়া ক্যাম্পাসে অনেকগুলো সংগঠনের মাধ্যমে সহ-শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসব সংগঠনগুলোকে প্রশাসন যদি সহযোগিতা করে তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে আরো এগিয়ে যাবে। গণঅভ্যুত্থানের আগে থেকেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা চলছিল। ফলে আমরা সব মিলিয়ে দীর্ঘ সেশনজটের মধ্যে আছি। সেগুলো কমিয়ে দ্রুত শিক্ষার্থীরা যাতে চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারে সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলবো প্রশাসনকে।
নিলয় সরকার, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।
রকি//বিএন