ইসলাম ধর্মে কোন খাদ্য হালাল আর কোনটি হারাম—তা নির্ধারিত হয়েছে আল কুরআন ও সহিহ হাদিসের মাধ্যমে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘোড়ার গোশত হালাল কি না, এ নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিশুদ্ধ ও সুপ্রতিষ্ঠিত হাদিসের আলোকে ঘোড়ার গোশতের বিধান নিয়ে প্রমাণসমূহ বিশ্লেষণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর প্রমাণ সহ বিস্তারিত লিখেছেন গোপালগঞ্জ কালিনগর আওলাদুর-রসুল( সল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দরবার শরীফের প্রধান পীর সাহেব কেবলা আল্লামা সায়িয়্যদ আনিসুল আরেফিন।
সুনান নাসায়ী (হাদিস নং: ৪৩৩১) সহিহ হাদিসের অন্যতম গ্রন্থে, শিকার ও যবেহ অধ্যায়ের ৩০ নম্বর পরিচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে, হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রাঃ) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন—“গাধা, খচ্চর ও ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল নয়।” হাদিসটির সনদে রয়েছে, “أَخْبَرَنَا إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ…” থেকে শুরু করে বহু প্রামাণ্য সূত্র, যা প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণ যেমন ইমাম নাসায়ী, ইবনে হিব্বান, ইমাম যাহাবী, এবং ইমাম আবু দাউদ কর্তৃক গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছে।
হাদিসটি নিয়ে যাঁরা সন্দেহ পোষণ করেন বা একে দইফ আখ্যা দিতে চান, তাঁদের জন্য রয়েছে পরিস্কার জবাব। প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা আ’ইনী (রহ.) বলেন, “সনদটি ‘জায়্যিদ’, অর্থাৎ ভালো পর্যায়ের।” এমনকি ইমাম আবু দাউদ এ হাদিসটি বর্ণনার পর নীরব থেকেছেন, যা ইঙ্গিত দেয় তাঁর মতে এটি ‘হাসান’ মানের হাদিস। এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, বর্ণনাকারী بقية যখন حدثني বলে হাদিস বর্ণনা করেন এবং তা شامের বর্ণনাকারী থেকে হয়ে থাকে, তখন সেটি حجّة বা দলিলরূপে গ্রহণযোগ্য। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে معين, আবু যরআহ, আবু হাতিম, নাসায়ী প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ একে প্রমাণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অন্যদিকে, যাঁরা হাদিসটি রহিত হয়েছে বলে দাবি করেন এবং হযরত জাবির (রাঃ) এর একটি বর্ণনায় ‘রুখসত’ বা ‘অনুমতি’ প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করেন, তাঁদের উদ্দেশে আল্লামা আ’ইনী (রহ.) সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, নবীজীর অনুমতি ছিল শুধুমাত্র “حالة المخمصة” অর্থাৎ তীব্র ক্ষুধার সময়ের জন্য, যা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। হাদিসের ঐ পটভূমিতে সাহাবায়ে কেরাম খায়বার অভিযানে যাচ্ছিলেন এবং তখন তাঁরা ক্ষুধার্ত ছিলেন। কাজেই সেটি বিশেষ পরিস্থিতির রুখসতমাত্র, সাধারণ সময়ের জন্য নয়।
তাছাড়া কেউ কেউ এই হাদিসকে জাল বলার চেষ্টা করেন এই ভিত্তিতে যে, খালিদ (রাঃ) খায়বার যুদ্ধের পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসবিদদের মতে, এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন তিনি হুদাইবিয়ার পরে ইসলাম গ্রহণ করেন, কেউ বলেন খায়বার ও হুদাইবিয়ার মাঝে, আবার কেউ বলেন ৫ হিজরিতে বনু কুরাইজার ঘটনার পরে। এমনকি যদি তিনি খায়বার যুদ্ধের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন, তাহলেও তাঁর মুরসাল হাদিস গ্রহণযোগ্য, কারণ সাহাবীগণ কখনো মিথ্যা বলতেন না। ইমাম ইবনুস সালাহ এবং অন্যান্য হাদিসবিদগণ সাহাবার মুরসাল হাদিসকে ‘মুত্তাসিল’ অর্থাৎ সংযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য সনদ বলে বিবেচনা করেছেন।
শুধু শরিয়ত নির্দেশনা নয়, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও ঘোড়ার গোশতকে মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছে। একাধিক জার্নাল ও গবেষণায় উল্লেখ আছে, ঘোড়ার মাংসে থাকে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণের আশঙ্কা, যেমন—জলাতঙ্ক, রিংওয়ার্ম, স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস, সালমোনেলোসিস, লেপ্টোস্পাইরোসিস, ক্রিপ্টোস্পোরিডিওসিস, ব্রুসেলোসিস এবং অ্যানথ্রাক্স। এইসব রোগের কিছু কিছু মারাত্মক ছোঁয়াচেও বটে।
অথচ আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরকম ক্ষতিকর খাদ্যকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “لاَ يَحِلُّ أَكْلُ لُحُومِ الْخَيْلِ وَالْبِغَالِ وَالْحَمِيرِ” অর্থাৎ “ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধার গোশত খাওয়া হালাল নয়।” (সুনান নাসায়ী)। আর তিনি আরও বলেন, “যে ব্যক্তি হারাম থেকে এক লোকমা খায়, তার চল্লিশ দিনের নামাজ কবুল হয় না।” (দেইলামি – ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত)।
অতএব, কেউ যদি বলেন “ঘোড়ার গোশত মাকরুহ”, কিংবা “হালাল”—তাহলে তাঁরা সরাসরি সহিহ হাদিসের বিরোধিতা করছেন। মহান আল্লাহ বলেন: “وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ”—অর্থাৎ, পবিত্র জিনিস হালাল করা হয়েছে, আর অপবিত্র ও ক্ষতিকর জিনিস হারাম। কাজেই, রোগ সৃষ্টি করে এমন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিষিদ্ধ কোনো কিছু হালাল হিসেবে দাবী করা যাবে না।
আজও ইউরোপের কিছু দেশে ঘোড়ার গোশতের উপর নিষেধাজ্ঞা চালু রয়েছে। ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে সায়েন্টিফিক জার্নালিস্ট নিনা ক্রিস্টিয়ানসেন লেখেন—ঘোড়ার মাংস হাজার বছর আগেই নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং আজও সেই মানসিকতা ও বিধান বহু মানুষের মাঝে বর্তমান। সুতরাং, মুসলমান হিসেবে রাসূল (সা.)-এর বাণী এবং সহিহ হাদিস মেনে চলা প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব। শরিয়াহ যদি কিছু হারাম ঘোষণা করে, তবে একে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানেই ঈমানের ঝুঁকি।