এক নজরে আলোচ্য গ্রন্থ সম্পর্কে:
নাম: আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০
লেখক: মহিউদ্দিন আহমদ
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মাসুক হেলাল
প্রকাশনা: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর, ২০১৬
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২৭১
উৎসর্গ: সাকিনা খাতুন (লেখকের মা)
অধ্যায়: ১৫
‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের এক ঐতিহাসিক নাম। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অব্যাহত অন্যায্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে অন্যতম প্রাণভোমরার ভূমিকা পালন করেছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটি।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের একাংশ এবং অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও, মূলত ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর নতুন জন্ম নেওয়া ভারত এবং পাকিস্তান (বিশেষত পূর্ব পাকিস্তান)-এর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ধীরে ধীরে এই দলটির আবির্ভাবের নেপথ্য হিসেবে কাজ করেছে।
প্রখ্যাত রাজনৈতিক ইতিহাসবেত্তা, লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাই বিভিন্ন তথ্যসূত্র এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দেওয়া সাক্ষাৎকার ও বক্তব্যের আলোকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলের জন্ম ও উত্থানের ইতিকথা তুলে ধরেছেন ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ গ্রন্থে।
মহিউদ্দিন আহমদের জন্ম ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক বছর ১৯৫২ সালে। পরে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। অর্থাৎ তাঁর কৈশোর ও যৌবনের সময়টা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পাশাপাশি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এক ঐতিহাসিক কালপরিসর। শুধু তাই নয়, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে ১৯৭০ সালে তিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী বছর তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেসের (বিএলএফ) অধীনে অংশ নেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহিউদ্দিন ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় করেন সাংবাদিকতাও।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত এই রাজনৈতিক ইতিহাসবেত্তা আলোচ্য গ্রন্থের পাশাপাশি ‘আওয়ামী লীগ: যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১’ ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’, ‘বিএনপি: সময়-অসময়’, ‘এক-এগারো বাংলাদেশ: ২০০৭-২০০৮’ প্রভৃতি জনপ্রিয় গ্রন্থেরও রচয়িতা। এ ছাড়াও, দেশের বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’-য় রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা বিষয়ের ওপর নিয়মিত কলাম লেখেন তিনি। তাঁর সকল রচনাই অন্তর্দৃষ্টি এবং বস্তুনিষ্ঠতা ও সমৃদ্ধ তথ্যসূত্রের ব্যবহারে রচিত। যা অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের উত্থান নিয়ে লেখা তাঁর এই আলোচ্য গ্রন্থটিকেও সর্ব মহলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে সহায়তা করেছে।
‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ গ্রন্থটি মহিউদ্দিন আহমদ দায়সারাভাবে লেখেননি। অনুসন্ধিৎসু মনন নিয়ে আওয়ামী লীগের উত্থানের বিষয়াবলী বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি চলে গিয়েছেন এগারো শতকের ‘বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ’ আল বিরুনীর ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে করা পর্যবেক্ষণে। সেখান থেকে ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে ভারতীয় উপমহাদেশের দুই বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায় তথা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং একে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের পরস্পরবিরোধী অবস্থান, ১৯৩৫-৩৬ সালে কৃষক-প্রজা পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া, ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতার ছাপ, অতঃপর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক উত্থাপিত ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’-এর ভিত্তিতে দেশবিভাগের বিশদ বিবরণের মধ্য দিয়ে লেখক আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার যে বর্ণনা গ্রন্থটিতে উপস্থাপন করেছেন তা পাঠকদের সমগ্র বিষয়ের ঘটনাপরম্পরা সহজে আত্মস্থ করতে ব্যাপক সহায়তা করেছে।
মূলত, পাকিস্তান জন্মের পরপরই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তথা মুসলিম লীগ সরকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিসহ সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। একে একে গড়ে ওঠে গণআজাদী লীগ, ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ, আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ: পরে আওয়ামী লীগ ভেঙে গঠিত হওয়া) প্রভৃতি রাজনৈতিক সংগঠন। ডান-বাম সকল ঘরানার এই রাজনৈতিক দল এবং জনসাধারণের সম্মিলিত অংশগ্রহণে ১৯৫২ সালে সংঘটিত হয় ভাষা আন্দোলন। এরপর ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত হওয়া যুক্তফ্রন্ট অনাকাঙ্ক্ষিত জয় পেয়ে জোট সরকার গঠন করলেও তাদের মধ্যে দেখা দেয় ব্যাপক টানাপোড়েন। মুসলিম লীগের মদদে জোটের শরিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি এবং কারো কারো মনে ঈষৎ কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার জন্ম হওয়ায় সে সময়ে জোটের এ ভঙ্গুর অবস্থার তৈরি হয়ে থাকতে পারে বলেও গ্রন্থটিতে উল্লেখ করেছেন লেখক।
তবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী সামগ্রিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র চর্চার পক্ষপাতী ছিল না। ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জার শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে তিনি সামরিক শাসন জারি করেন। এই সুযোগে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান আইয়ুব খান দেশের শাসনক্ষমতায় আরোহণ করে সারা দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। এ ছাড়াও, তাঁর ইন্ধনে নিরাপত্তা বাহিনী শুরু করে গণগ্রেপ্তার। পরে তিনি ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে বিশেষ শাসনতন্ত্র চালু করেন। যা আদতে প্রকৃত গণতন্ত্রের সমকক্ষ ছিল না। অধিকন্তু, ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের সময়কার বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্রসমাজ আবারও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
এ সময় ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) নামে সকল বিরোধী দলের একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ আরও তিনটি দল এ জোটের অংশ হয়। তবে এ জোট কার্যত নিষ্ক্রিয়ভাবেই বিরাজমান থাকে। পরে ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার আকাঙ্ক্ষায় নজিরহীন গোপনীয়তায় ভারতের আগরতলায় গিয়ে দেশটির সরকারের কাছে সহায়তা চান। তবে ভারত সরকার তখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের বিষয়টির ওপর নীতিগত সমর্থন দেয়।
ফলে দেশে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ নেন। এতে দলটি এনডিএফ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের স্বতন্ত্র সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। পরে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তির সনদখ্যাত ‘ছয় দফা’ দাবি উত্থাপন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব প্রশাসন শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে তাঁদের গ্রেপ্তার করে। পরে গণআন্দোলনের মুখে এ মামলা খারিজ করা হয়। মুক্তি পান বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজবন্দী। পতন ঘটে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের।
এরপর নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেন আরেক স্বৈরশাসক মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি ক্ষমতাগ্রহণ করেই নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেন। অবশেষে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পূর্ববর্তী শাসকদের মতো তিনিও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি হয় এবং পরের বছর সংঘটিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। এই হলো সংক্ষেপে আলোচ্য গ্রন্থের সারগর্ভ।
পরিশেষে বলা যায়, সমৃদ্ধ তথ্যসূত্র এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা ব্যক্তির সাক্ষাৎকার ও বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত মহিউদ্দিন আহমদের এই রচনা প্রকৃতপক্ষেই এক অনন্য কর্ম। এ বইয়ে লেখক শুধু একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উত্থানের ইতিহাস লেখেননি, বরং ধারাবাহিকভাবে এ দলের প্রতিষ্ঠা এবং উত্থানের অবশ্যম্ভাবিতার বাস্তব প্রেক্ষাপটের দিকেও আলোকপাত করেছেন। তবে অন্যান্য ইতিহাসবেত্তার রচনার চেয়ে তাঁর এই রচনা আরও বেশি স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে এ দলটির উত্থানকালের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মাঝে দেখা দেওয়া দ্বন্দ্বসমূহ এবং সেগুলো সুরাহা করার প্রসঙ্গের সূক্ষ্ম অন্তর্ভুক্তির কারণে। পাশাপাশি, তিনি এই ঐতিহাসিক বছরগুলোতে নানা সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্যান্য দলের জোটবদ্ধ হওয়ার এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই জোটসমূহ ভেঙে যাওয়ার কারণ ও দিকসমূহও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এ সব প্রসঙ্গ বর্ণনা করতে গিয়ে স্বভাবতই বারংবার সামনে এসেছে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ নেতৃত্বের চিত্র। ফলে গতানুগতিক কোনো পুস্তক না হয়ে সামগ্রিকভাবে এ গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে একটি দল, একটি নেতা এবং একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্মের মহাকাব্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।