বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ ২০২৫) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) বুদ্ধিজীবী চত্বরে আমার দেশ পাঠকমেলার প্রথম পাঠচক্র অনুষ্ঠিত হয়।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী সৈয়ব আহমেদ সিয়ামের সঞ্চালনায় পাঠচক্রে আলোচ্য বই ছিলো লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা “আসমান” উপন্যাস। মূখ্য আলোচক ছিলেন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ত্রিসানুর রহমান।
পাঠচক্রে উপস্থিত ছিলেন ক্রিমিনোলজি & পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী এস.এম সিহাব, স্পোর্টস সায়েন্সের মোঃ সামিউর রহমান, প্রাণিবিদ্যার আজিম খান, মৃত্তিকা বিজ্ঞানের মোঃ রিদওয়ান সরকার এবং লোকপ্রশাসন বিভাগের মো. মশিউর রহমান দূর্জয়, আছানুল হক বাপ্পী ও মোঃ জিহাদ আলী।
বসন্ত আর রমজান একসাথে। পাহাড়ঘেরা সবুজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বসন্ত হয়ে ওঠে আরো প্রাণবন্ত। এমনি এক বসন্তের পড়ন্ত দুপুরে গাছের ছায়ায় অনুষ্ঠিত হলো পাঠকমেলার পাঠচক্র।
“আসমান” – যে গল্প জীবনের চেয়েও বড়। আসমান উপন্যাসের শুরুটা এভাবে, “‘হৃদয় আল্লাহর ঘর। মানুষের হৃদয়টা তৈরি করা হয়েছে এই জন্য যে সেখানে শুধুমাত্র আল্লাহ থাকবেন। সে ঘরে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু ঢুকালেই শুরু হবে তোমার জাগতিক অশান্তি।”
সৈয়ব আহমেদ সিয়ামের পাঠ বর্ণনায়, “ওমার- হৃদয়ঘটিত কারণে যে যুবক হতাশার অতল সমুদ্রে হারিয়ে গিয়ে মজে যায় নেশার ধ্বং*সাত্মক দুনিয়ায়। তার জীবনে ইসলাম কেমন করে পরিবর্তন আনে। হয়ে ওঠে ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ঢাকার বিশেষ কিছু কুখ্যাত অলিগলি যার নখদর্পণে সে কেন আফগানিস্তানের যুদ্ধের মাঠে। যার খেসারত দিতে হয় ১২ বছর কুখ্যাত গুয়ান্তানামো বে কারাগারে বিনা বিচারে জেল খেটে- অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে। কিন্তু পরম করুণাময় কি এতই নিষ্ঠুর যে তার জীবন কে এক বিয়োগ গাঁথা হিসেবেই লিখবেন? না- তিনি পরম করুণাময়, প্রত্যেকের জন্য যিনি রেখেছেন উত্তম প্রতিদান। তাই উপন্যাসের শেষে ওমার যেন এক মুক্ত বিহঙ্গ- সে খুশি এক আসমান ভালবাসা নিয়ে। কোন অন্ধ বুলি নয়। তীক্ষ্ণ যুক্তি দিয়ে গড়া ধর্ম ইসলাম। ইসলামের দর্শন নিয়ে আমরা কমই ভাবি। উপন্যাসটি আপনাকে ভাবাবে। আছে রক সংগীতের গল্প, ঢাকার অলি গলির গল্প। এবং শেষে অপ্রত্যাশিত চমক।
আমেরিকার কুখ্যাত জেল গুয়ান্তানামাে বে থেকে বিনা বিচারে ১২ বছর জেল খেটে মুক্তি পেয়েছে এক বাংলাদেশি। ওয়াশিংটন পােস্টের এই খবরে চমকে গেছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সাফ জানিয়ে দিয়েছে এমন সন্ত্রাসীর দায়িত্ব বাংলাদেশ নেবে না। আমেরিকান আর্মির কার্গো প্লেন তাকে ফেলে গেছে আলবেনিয়ার তিরানা বিমান বন্দরে । ট্রাভেল ডকুমেন্টহীন দেশহীন মানুষটাকে পৃথিবীর কোনাে দেশ রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় না। রিফিউজির স্ট্যাটাস নিয়ে তাকে থাকতে হবে রেডক্রসের শেল্টারে। মানুষটা এখন কোথায় যাবে? চেনা সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলে, একটা অচেনা দরজা খুলে যায়, জীবন বন্দি হয়ে গেলে সেটা জীবনকেও ছাপিয়ে যায়, সেই জীবনের গল্প জীবনের চেয়েও বড় হয়ে যায়… The Fiction Based on Fact এই উপন্যাসের স্থান সত্য, কাল সত্য, ইতিহাস সত্য, কাল্পনিক শুধু এর চরিত্রগুলাে।”
আজকের পাঠচক্রের মূখ্য আলোচকের পক্ষ থেকে আসমান উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত রিভিউ নিম্নরূপ:
“আসমান। সম্প্রতি সাহিত্যের আঙিনায় অন্যতম আলোচিত একটি উপন্যাস লতিফুল ইসলাম শিবলী রচিত ‘আসমান’। শত শত পথভ্রষ্ট যুবককে অনুপ্রেরণাদায়ী এ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে। প্রকাশের পর থেকেই পাঠকসমাজে দারুণ আলোড়ন তৈরি করে ‘আসমান’।
উপন্যাসটি রচিত হয় এক হতাশাগ্রস্ত যুবক ওমারকে কেন্দ্র করে, যে প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদের ফলে স্বাভাবিক জীবন থেকে চলে যায় বহু দূরে। হতাশা থেকে বাঁচতে নেশার দিকে ঝুঁকেও লাভ হয় না। সাময়িক শান্তি পেলেও মেলে না চূড়ান্ত মুক্তি। পরবর্তীতে এক বৃদ্ধ ইমাম ইসহাক সাহেবের সান্নিধ্যে এসে ধীরে ধীরে আলোর পথে অগ্রসর হয় ওমার। আল্লাহর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে হৃদয়ে মেলে প্রশান্তি।
এক পর্যায়ে তাবলীগের সাথে যুক্ত হয়ে পাকিস্তান সফরে যায় ওমার। এখানে লেখক তাবলীগ প্রথার কিছুটা সমালোচনাও করেছেন। তাবলীগের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট না থাকলেও ওমার নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তান সফরে যায় এবং সেখানে গিয়ে আফগানিস্তানে চলমান যু*দ্ধের ব্যাপারে জানতে পারে। আফগানিস্তানের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে ওমার আফগানিস্তানে চলে যায়। সেখানে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে উপন্যাস এগিয়ে যায়। লেখক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিরায়ত ইসলাম বিদ্বেষী আচরণ এবং বর্বরতার চিত্র তুলপ এনেছেন।
উপন্যাসে ওমার এক পর্যায়ে মার্কিনী বাহিনীর হাতে ধরা পরে এবং তাকে কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগারে আটক রাখা হয়। গুয়া*নতামতো বে কারাগারের অমানবিক নির্যাতনে কিছুটা বর্ণনা পাওয়া যায় উপন্যাসে। সারা পৃথিবীতে মানবাধিকারের মিষ্টি বুলি ছড়ানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কপটতা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে।
অবশেষে দীর্ষ ১২ বছর কারাগারে অবরুদ্ধ থাকার পরে মুক্তি পায় ওমার। মার্কিন সামরিক বিমান তাকে আলবেনিয়ার একটি বিমান বন্দরে পৌঁছে দেয়ার পর সে অসহায় বোধ করে। স্ত্রী-পরিবারের কোনো খোঁজ সে জানে না, বাংলাদেশ সরকারও তাকে ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানায়। সব মিলিয়ে তার সকল পথ রুদ্ধ। চেনা সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলে এক অচেনা দরজা খুলে যায়। স্ত্রী-সস্তানকে ফিরে পেয়ে আকষ্মিকভাবে তার সামনে উন্মোচিত হয় নতুন এক পথ। জীবন বন্দি হয়ে গেলে সেটা জীবনকেও ছাপিয়ে যায়। মানুষের সমস্ত চিন্তা-চেতনার উর্ধ্বে বিরাজ করে মহান সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা, এ বিষয়টিকেই দারুণভাবে উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন শিবলী।”
সদস্যদের অংশগ্রহণে আসমান নিয়ে প্রাণবন্ত ছিলো পাঠকমেলার পাঠচক্র।
– সৈয়ব আহমেদ সিয়াম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়