এক ভোরবেলায় আলো ফোটার কিছুক্ষণ পর রংপুর নগরীর সর্দারপাড়া এলাকায় রাস্তায় হাঁটছিলাম। রাস্তার ধারে ধূসর আলোয় ধুয়ে যাচ্ছিল শহরের ক্লান্ত শরীর।
তখন হঠাৎ চোখে পড়লো গায়ে লাল-হলুদ ছোঁপধরা জামা গায়ে একটা শিশু বসে আছে। আর তার পেছনে দেয়ালে লাগানো একটি ছেঁড়া পোস্টারে লেখা: “বদল আনো, নিজেকে দিয়ে শুরু করো।”
আমার পা থেমে গেল। না, শুধু পোস্টারের জন্য নয়। ওই ছেলেটার জামার রঙের জন্য। পোস্টারের অর্ধেক মোচড়ানো শব্দের জন্য। আমার মাথায় হঠাৎ ঝড় তুলতে উদ্যত হওয়া এক প্রশ্নের জন্য।
চিন্তা করা দরকার কেন?
আমার মনে হলো— জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত হাঁটি, খাই, কাজ করি, দেখি, শুনি, লিখি। কিন্তু কয়টা জিনিসকে আমরা আসলেই ‘দেখি’? কয়টা জিনিসকে আসলেই ‘শুনি’?
চোখে পড়ে মানেই তো শুধু দেখা নয়। শব্দ কর্ণকুহরে ঢোকা মানেই তো শুধু শোনা নয়। কারণ সবকিছু দেখা আর শোনা হয় অনুধাবনের মধ্য দিয়ে।
সেই দিক হতে আমাদের সামনে আসছে চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা। চিন্তা করা মানে হচ্ছে, আমাদের দেখা বা শোনা জিনিসগুলোর ভেতরে ঢোকা। ঢুকে প্রশ্ন তোলা।
আমি যখন ছোট ছেলেটার জামা দেখলাম—তখন আমার মনে হলো, এটা কি তার নিজের পছন্দে কেনা? নাকি দান করা কারও পুরোনো পোশাক?
আর পোস্টারে লেখা সেই স্লোগান—“নিজেকে দিয়ে শুরু করো”—এটা কি শুধুই জনসংযোগ কিংবা প্রচারণার কৌশল, নাকি সত্যিকারের ডাক?
আমরা যদি না চিন্তা করি বা ভাবি, তাহলে এত সব মারপ্যাচ বুঝব কীভাবে—কোনটা সত্যি আর কোনটা সাজানো?
স্কুলে পড়ার সময় আমার এক শিক্ষক একবার বলেছিলেন, চিন্তা না করলে তুমি ‘ব্যবহৃত’ হবে। কিন্তু চিন্তা করলে তুমি ‘নির্মাতা’ হবে।
এখন আমার মনে হয়, আমরা এই ব্যবহৃত হওয়ার যুগেই বসবাস করছি। নার্সিসিজমে আক্রান্ত নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিউজফিড, নজরকাড়া সব বিজ্ঞাপনী বার্তা, দোদুল্যমান মতাদর্শের উচ্চকিত প্রপাগান্ডার ঝাণ্ডা, নানা ইস্যুতে কথিত অনলাইন ‘জনমত’-এর স্ফীত সংখ্যা—সবই আমাদের জন্য সাজানো।
তাই এসবের ঊর্ধ্বে উঠে কারো কোনোকিছু নতুন করে চিন্তা করার মানেই হলো, তিনি নিজেই নিজের মতো করে সত্যিটা খোঁজেন বা খুঁজতে চান।
কিন্তু কীভাবে চিন্তা করা যায়?
আমার মতে, কোনো বিষয়ে চিন্তা করার প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রশ্ন করা। সে বুঝে হোক বা না বুঝে।
এই ধরুন, ছেলেটার জামা দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো—সে কোথায় থাকে? ও কি স্কুলে পড়ে? ওর অভিভাবকেরাই-বা কোথায়? তারা কী করেন?
আমি যখন এ সমস্ত কথা ভাবি, তখন একেকটা প্রশ্ন আমাকে এই শহরের গভীরে নিয়ে যায়—আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়, আমাদের বঞ্চনার রাজনীতিতে আর সামাজিক কাঠামোর বাঁকে বাঁকে।
দ্বিতীয় ধাপ হলো, কোনোরূপ পর্দা বা অবয়ব ছাড়া যে কোনো কিছুকে পরখ করে দেখা ও শোনা।
আদতে বর্তমান দুনিয়ায় আমরা যা দেখছি, তা কেউ না কেউ আমাদের দেখাতে চাইছে। সোশ্যাল মিডিয়ার বহুবিধ কন্টেন্টগুলো পরিশোধিত করা করা নিউজপোর্টালগুলোর শিরোনাম নির্ধারণ করা থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থায় কোন ধরনের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হবে— এই সবকিছুই আমাদের কিছু না কিছু দেখায়, শোনায় এবং বোঝায়।
সেই আঙ্গিক থেকে আপনি যদি রাস্তার পোস্টার বা শিশুর জামা নিজে নিজে ‘পড়তে’ শেখেন—তাহলে আপনি নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে শুরু করবেন। এমনকি এই চিন্তার সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে প্রচলিত গণ্ডিকেও।
তৃতীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সন্দেহ করার সাহস।
আমরা জীবনে অনেক কিছুই বিশ্বাস করি। পরিবারের সদস্যরা আমাদের যা শিখিয়েছেন, শিক্ষকেরা আমাদের যা বলেছেন, জনপ্রিয় নেতারা আমাদের যা শুনিয়েছেন। কিন্তু একজন যখন এসব বিষয় নিয়ে অনুপুঙ্খ চিন্তায় লিপ্ত হয়, তখন তিনি বিশ্বাস করার পাশাপাশি প্রশ্নও তোলেন।
সন্দেহ করা মানেই অবিশ্বাস নয়—এটা চিন্তা করার সম্প্রসারিত রূপ মাত্র। কারণ কোনো কিছু ভাবা মানে শুধু সেই জিনিসটার গভীরে যাওয়া নয়, বরং আর্থ-সামাজিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় এটা একটা নৈতিক কাজও বটে।
একজন ভাবনাহীন মানুষ যেমন নিঃসাড়, তেমনি ভাবনাহীন সমাজ নিষ্ঠুর। সেখানে মানুষের বিবেক ও জীবনবোধ হয়ে পড়ে শৃঙ্খলিত। ফলে দেখা যায়, রাস্তায় কেউ মার খায়, কেউ ক্ষুধার্ত থাকে, কেউ হেরে যায়—আর আমরা শুধু “আহা!” বলি।
কিন্তু চিন্তা করলে প্রশ্ন উঠতো—ভুক্তভোগী মানুষটার প্রতি এই বঞ্চনা কেন? এর দায় কার?
সে দিক থেকে বলতে গেলে, চিন্তা আমাদের মানবিকতাকে জাগিয়ে তোলে। চিন্তা না করলে আমাদের মনে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না। প্রশ্ন উত্থাপিত না হলে সমাজের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাগুলো নিয়ে আমাদের বিবেক সংবেদনশীল হয় না। আর সংবেদনশীল বিবেক ছাড়া সমাজে পরিবর্তন আসে না।
কেননা প্রতিটি পরিবর্তনের শুরুই হয় একটা ‘মাথার ভেতরের আন্দোলন’ দিয়ে। আর সেটাকে উস্কে দেয় অনুপুঙ্খ চিন্তা করার স্বভাব!