বর্তমানে রাস্তায় বের হলে প্রায় অনেক মানুষের চোখে চশমা দেখা যায়। বয়স্ক মানুষদের চোখে তো চশমা দেখা যায়ই, এমনকি শিশু-কিশোর এবং তরুণদের চোখেও চশমার উপস্থিতি নেহাত কম নয়।
চক্ষুবিশেষজ্ঞদের মতে, বয়স্কদের সাধারণত কাছের জিনিস বা লেখা দেখতে সমস্যা হওয়ায় তারা চশমা ব্যবহার করেন। কিন্তু শিশু থেকে যুবক অবধি যারা চশমা ব্যবহার করেন তাদের বেশিরভাগই মায়োপিয়ায় আক্রান্ত। অর্থাৎ দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখতে না পারায় চশমা ব্যবহার করেন তারা।
মায়োপিয়া হল সবচেয়ে সাধারণ চোখের সমস্যা। অনুমান করা হয় বিশ্বজুড়ে দেড় বিলিয়ন মানুষ (বিশ্ব জনসংখ্যার ২২%) এই জটিলতার দ্বারা প্রভাবিত হন (সূত্র: উইকিপিডিয়া)।
বোঝাই যাচ্ছে এর এই হার বর্তমান বিশ্বে কতটা বেড়ে গেছে। এবং মায়োপিয়া বর্তমানে একটি বিশ্ব মহামারী আকার ধারণ করেছে। চশমা আবিষ্কারের আগেও মানুষের চোখের সমস্যা ছিল না তা নয়, কিন্তু নগরায়ণ এবং আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চোখের সমস্যা বিশেষ করে মায়োপিয়া দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইতিমধ্যে সাম্প্রতিক বেশকিছু গবেষণায় সতর্ক করে বলা হয়েছে, ক্ষীণদৃষ্টি বা মায়োপিয়া সারা বিশ্বেই এখন ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যজনিত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাড়তি কয়েক মিলিয়ন শিশুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এই দৃষ্টি জটিলতা।
সাধারণত মায়োপিয়া শুরু হয় শিশুর প্রাথমিক স্কুলের বয়স থেকে। শিশুর চোখের বিকাশ না থামা, অর্থাৎ প্রায় ২০ বছর বয়স পর্যন্ত আরও খারাপ হওয়ার প্রবণতা থাকে এটির।
মায়োপিয়ার অনেক কারণ রয়েছে এবং এই যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে যে কারণটিকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় তা হলো মোবাইল ও কম্পিউটারের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি এবং ঘরের বাইরে সময় কম কাটানো।
এ ছাড়া, আরও কয়েকটি কারণ গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন। মায়োপিয়ার বিকাশ জিনগত প্রবণতা এবং পরিবেশগত প্রভাবগুলির মধ্যে একটি জটিল আন্তঃসংযোগের ফলেও হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মায়োপিক পিতামাতার শিশুদের এই অবস্থার বিকাশের উল্লেখযোগ্য হারে উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে। একটি মায়োপিক দম্পতির সন্তানের মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ হলেও দুটি মায়োপিক দম্পতির সন্তানের মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ছয় গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

মায়োপিয়ার অন্যতম কারণ ডিজিটাল ডিভাইসে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা। ডিজিটাল ডিভাইসে তথা মোবাইল কম্পিউটারের সফটওয়্যারগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা যে যে কোনো মানুষ তাতে অনায়াসে আকৃষ্ট হন, শিশুরা তো সেখানে হবেই।
❝বর্তমানে অভিভাবকেরা শিশুকে ঘরে আটকে রাখতে এবং দুষ্টুমি করা থেকে বিরত রাখতে তাদের হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেন। ফলে মোবাইলে ভিডিও দেখা কিংবা গেম খেলতে খেলতে শিশুরা অনায়াসে দুই-তিন ঘন্টা কাটিয়ে দেয় এবং এরপরও ছাড়তে চায় না।কিন্তু এটা যে তাদের চোখের কতটা ক্ষতি করছে বাবা-মা এই বিষয়ে খেয়ালই রাখেন না।❞
গবেষণায় দেখা যায়, বড়জোর টানা ২০ মিনিট আমরা স্ক্রিনে চোখ রাখতে পারি, এবং এরপরই অন্তত ৫ মিনিট আমাদের স্ক্রিনটাইম অফ করা উচিত। যারা কম্পিউটারে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা মেনে চলা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে৷ কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে তা মোটেও কঠিন নয়। এ বিষয়ে বাবা মাকে সচেতন হতে হবে।
এ ক্ষেত্রে, শিশুদের জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি স্ক্রিনটাইম নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে। তারা যে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করবে না এমন নয়, কিন্তু তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
এর পাশাপাশি, মায়োপিয়ার আরেকটি গুরুতর কারণ বলা হয় প্রকৃতিতে সময় কম কাটানো। যান্ত্রিক সভ্যতা ও নগরায়নের কারণে আমরা এক প্রকার খাঁচায় বন্দি হয়ে গিয়েছি। আমাদের আশেপাশের খেলার মাঠ নেই, শিশুরা সারাদিন বাসায় সময় কাটায়, এমনকি বাসায় উঠান অবধি নাই।
তার উপর বাবা মা ভাবেন খেলাধুলা করা হলো একপ্রকার সময় নষ্ট। তাই তারা বাচ্চাকে সারাদিন পড়াশুনায় এবং আরও অনেক কাজে ব্যস্ত রাখেন, এবং তাদের অবসর সময়ে তাদের হাতে থাকে মোবাইল বা কম্পিউটার। ফলে চোখে প্রাকৃতিক আলো পৌঁছানোর কোনো সুযোগই থাকে না।
❝গবেষকরা বলে থাকেন, প্রতিদিন কমপক্ষে ঘন্টা খানেক সময় প্রকৃতিতে কাটাতে হবে। এতে শরীরের সব অঙ্গ সতেজ থাকে। উপরন্তু, আমাদের মনে রাখতে হবে মায়োপিয়ার কোনো প্রাকৃতিক প্রতিকার নেই। একবার চশমা চোখে উঠলে আমরা বড়জোর চোখের যত্ন নিয়ে মায়োপিয়ার ভয়াবহ রূপ ধারণ করা থেকে আটকাতে পারি। আর প্রাপ্তবয়স্ক হলে ল্যাসিক বা অন্যান্য অপারেশনের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি পুনরায় ফেরানো সম্ভব। কিন্তু তা ব্যয়বহুল।❞
তাই আমাদের এখন থেকেই চোখের যত্ন নিতে হবে এবং যাদের মায়োপিয়া হয়েছে তাদের যেন অবস্থা আরও খারাপ না হয় সে জন্য চোখের যত্ন নিতে হবে। এ জন্য আমাদের ভিটামিনযুক্ত সুষম খাবার খেতে হবে, নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করাতে হবে, ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিনটাইম যতটা সম্ভব কমাতে হবে, চোখকে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া থেকে মাঝে মাঝে চাপমুক্ত রাখতে হবে এবং প্রকৃতিতে সময় কাটাতে হবে।
আমাদের নিজেদেরকে এবং শিশুদের বাবা মায়েদের এখনই সচেতন হতে হবে। নয়তো, এই মায়োপিয়া আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে বেশি সময় লাগবে না।