দি ইকোনমিস্ট: এক সময় জাপানে চাকরি ছেড়ে অন্যত্র যোগ দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কেউ যদি এমন করতেন, তাহলে তাকে বলা হতো বিশ্বাসঘাতক। তবে সময় বদলেছে। মানুষও আত্মবিশ্বাসী হয়েছে। ফলে তাঁরা খাপ খাওয়াতে না পারলে ছেড়ে দিচ্ছেন চাকরি। কিন্তু এর নেপথ্য কী কারণ রয়েছে, সেটাও দেখে নেওয়া যাক্।
কাওয়াতা ইয়াসুতোশি, এক হেভি মেটাল ব্যান্ডের প্রাক্তন গিটারিস্ট, কখনোই জাপানের ঐতিহ্যবাহী কর্পোরেট পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। বড় একটি ইলেকট্রনিক্স প্রতিষ্ঠানে কাজ করাকালীন তিনি সিনিয়র-জুনিয়র কাঠামোসহ নানা অনুশাসনে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। অফিসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা কিংবা বাধ্যতামূলক সামাজিক আড্ডাগুলো তাকে ক্লান্ত করত।
চাকরি ছাড়াও সহজ ছিল না; যখন তিনি একটি বহুজাতিক আইটি কোম্পানিতে যেতে চাইলেন, তখন ঊর্ধ্বতনরা তাকে কড়া সমালোচনা করেন, ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিতেও পিছপা হননি। এখন, প্রায় ৫০ ছুঁইছুঁই বয়সে, তিনি আবার নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। কাওয়াতা বলেন, ‘আমি সবসময় নতুন চ্যালেঞ্জের খোঁজে থাকি।’
এখন কাওয়াতার মতো মানুষ আর ব্যতিক্রম নন। আগে জাপানের আদর্শ কর্মী মানে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শেষে একটানা একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যাওয়া, ধীরে ধীরে পদোন্নতি পাওয়া, এবং নানারকম সুবিধা ভোগ করা। কিন্তু এই সংস্কৃতি এখন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে।
যদিও জাপানে এখনও পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় চাকরি বদলানোর হার কম, তবুও সেখানে এই প্রবণতা বাড়ছে। ২০২৪ সালে প্রায় ৯ লাখ ৯০ হাজার পূর্ণকালীন কর্মী চাকরি বদলেছেন, যা দশ বছর আগের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি। জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ২১ শতাংশ তরুণ কর্মী জানিয়েছেন যে তারা অবসর পর্যন্ত একই প্রতিষ্ঠানে থাকতে চান, যেখানে ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ।
এর পেছনের মূল কারণ হলো দেশের জনসংখ্যার পরিবর্তন। কাজের যোগ্য মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় কর্মীদের দরকষাকষির ক্ষমতা বেড়েছে। এখন অর্ধেকের বেশি কোম্পানি দক্ষ কর্মীর ঘাটতিতে ভুগছে। এমনকি সরকারি চাকরিতেও আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকে।
জাপানের ‘স্যালারিম্যান’ সংস্কৃতি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে গড়ে উঠেছিল। কর্মীরা দিনের পর দিন কাজ করতেন, অফিস শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতেন। ১৯৮০ সালের এক বিজ্ঞাপনে প্রশ্ন করা হয়েছিল: ‘আপনি কি ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে পারবেন?’
তবে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম এই ধারা বদলাতে চাইছে। ১০ বছর আগেও যেখানে মাত্র ২ শতাংশ পুরুষ পিতৃত্বকালীন ছুটি নিতেন, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশে।
হিতোৎসুবাশি ইউনিভার্সিটির ওনো হিরোশি বলেন:
❝শোয়া যুগের কর্মপন্থা ভেঙে পড়ছে। অনেকে কাজে আনন্দ পান না। আমি নিজেই চাকরিজীবীদের স্টার্টআপের সঙ্গে যুক্ত করতে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি৷ এবং এটা নিয়েই নিমগ্ন আছি।❞
অফিসে এখন প্রজন্মগত দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। তরুণ কর্মীদের অভিযোগ, ‘হাতারাকানাই ওজিসান’-রা, অর্থাৎ কর্মহীন বৃদ্ধ কর্মীরা অফিসে ঘুরে বেড়ান, অথচ কঠোর শ্রম আইন তাদের রক্ষা করছে।
এক জরিপ অনুযায়ী, তরুণ কর্মীদের প্রায় অর্ধেক মনে করেন, এসব প্রবীণ কর্মীরা অফিসের মনোবল নষ্ট করছেন। তারা বড় পদ আঁকড়ে থাকায় তরুণদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। তরুণেরা মজা করে এসব পুরোনো সহকর্মীদের ‘উইন্ডোজ ২০০০’ নামে ডাকেন।
করোনার সময়েও জাপানে বেকারত্বের হার ৩ শতাংশ ছিল, যেখানে আমেরিকায় তা ১৫ শতাংশ ছুঁয়েছিল। এই শ্রমবাজারকে এক গবেষক বলেছেন ‘স্থবির বাথটাব’।
এরপরও সংস্কারের দাবি জোরালো হচ্ছে। ২০১৯ সালে দেশটির বড় ব্যবসায়ী সংগঠন আজীবন চাকরির ধারণাকে ‘অপর্যাপ্ত’ বলে ঘোষণা দেয়। এমনকি রাজনীতিতেও এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু বয়সভিত্তিক বাধা ভেঙে পড়ছে। ৪০ বা ৫০ পেরিয়েও অনেকে এখন চাকরি বদলাচ্ছেন। গত এক দশকে এই বয়সী কর্মীদের চাকরি বদলানোর হার ছয়গুণ বেড়েছে।
৪৪ বছর বয়সী ওয়াকাতসুকি মিতসুরু প্রায় দুই দশক পর চাকরি ছাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘চাইলেই আমি ওই চাকরিতে আরও ২০ বছর কাটাতে পারতাম। কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি কি এটা সত্যিই চাই?’
চাকরি বদলানো কর্মীদের মধ্যে অনেকেই বেতন বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি কম্পানিগুলোও এখন মাঝারি বয়সী দক্ষ কর্মীদের নিয়োগ করছে।
এ পরিবর্তন জাপানের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষকেরা মনে করছেন, বাড়তে থাকা চাকরি বদলানোর হার ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও উন্নত করবে।
আইটি কর্মী কাওয়াতা বলেন, “জাপানি কোম্পানিগুলোকে বাইরে থেকে নতুন বাতাস সরবরাহ করা দরকার। তাহলে জব সেক্টরে আসতে পারে পরিবর্তন।”