ডেঙ্গু একটি ভাইরাল সংক্রমণ যা ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়। এটি এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। বিশেষত এডিস এজিপ্টি এবং এডিস আলবোপিকটাস প্রজাতির মশা। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ (ডেঙ্গু ভাইরাস ১, ২, ৩, ৪) রয়েছে, এবং যে কোনও একটিতে সংক্রমিত হওয়ার পর, পুনরায় অন্য সেরোটাইপ দ্বারা সংক্রমিত হলে ডেঙ্গুর গুরুতর রূপ যেমন ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS) হতে পারে।
ডেঙ্গুর উপসর্গঃ
ডেঙ্গু সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং এর উপসর্গগুলি সাধারণ ফ্লুর মতো হলেও, এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুতর হতে পারে। উপসর্গগুলি মধ্যে রয়েছে:
১। উচ্চ জ্বর
২। তীব্র মাথাব্যথা
৩। পেশীতে ও জয়েন্টে ব্যথা
৪। চোখের পিছনে ব্যথা
৫। ত্বকে ফুসকুড়ি বা লাল দাগ
৬। অরুচি বা বমি
৭। ক্লান্তি ও দুর্বলতা
৮। গুরুতর ক্ষেত্রে, রোগীর রক্তক্ষরণ, শক, এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতির মতো জীবননাশক অবস্থাও হতে পারে।
ডেঙ্গুর প্রতিকারঃ
ডেঙ্গুর জন্য কোনও বিশেষ এন্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই। চিকিৎসা মূলত উপসর্গগুলির ভিত্তিতে করা হয় এবং সমর্থনমূলক যত্ন প্রদান করা হয়। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলোঃ
১। হাইড্রেশন: প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহণ, যেমন জল, স্যুপ, ওরস এবং স্যালাইন সলিউশন রোগীর রক্তচাপ এবং জলাশয় বজায় রাখতে সাহায্য করে।
২। পেইন রিলিফ: প্যারাসিটামল সাধারণত জ্বর এবং ব্যথা কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে অ্যাসপিরিন এবং অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ওষুধ ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এগুলি রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৩। মেডিক্যাল মনিটরিং: গুরুতর ক্ষেত্রে, রোগীর রক্তের সঞ্চালন এবং রক্তচাপ মনিটরিং করা প্রয়োজন এবং হাসপাতালে ভর্তি প্রয়োজন হতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধঃ
ডেঙ্গুর প্রতিরোধ মূলত মশার কামড় থেকে সুরক্ষা পাওয়ার উপর নির্ভর করে। এটি নিশ্চিত করার জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
১। মশার প্রজনন স্থল নির্মূল করা: মশা তাদের ডিমগুলো জলযুক্ত স্থানে পাড়ে, তাই বাড়ির চারপাশে, বাগানে এবং জলাশয়ে জল জমা না হতে দেওয়া উচিত। পুরনো টায়ার, কলসি, ফুলের টব, এবং অন্যান্য জল ধারণকারী বস্তু পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে।
২। মশা প্রতিরোধী প্রোডাক্ট ব্যবহার করা: মশা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য রিপেলেন্টস, যা ডিট, পিকেরিডিন বা ইক্যালিপটাস তেল ধারণ করে, ব্যবহার করা উচিত। এছাড়া মশারী এবং মশা প্রতিরোধক আচ্ছাদন ব্যবহার করা প্রয়োজন।
৩। বস্ত্র ও পোশাকের মাধ্যমে সুরক্ষা: দীর্ঘ হাতা ও প্যান্ট পরিধান করা এবং বডি সুরক্ষা তৈরির জন্য মশারী ব্যবহার করা উচিত।
৪। মশা নিয়ন্ত্রণ উদ্যোগ: স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা যেমন মশা নিধনের ওষুধ ছিটানো এবং মশা বিস্তারের স্থানগুলি নিয়ন্ত্রণ করা।
৫। জ্বর হলে সতর্কতা: যদি কাউকে ডেঙ্গু উপসর্গ দেখা যায়, বিশেষ করে জ্বর, তার দ্রুত চিকিৎসার জন্য ডাক্তারকে পরামর্শ করা উচিত এবং রোগীর অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত।
প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপঃ
ডেঙ্গুর প্রভাব কমানোর জন্য কিছু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে:
১। জলাধার নিয়ন্ত্রণ: বাড়ির চারপাশে জল জমতে না দেওয়া এবং মশার প্রজননস্থল নির্মূল করা।
২। মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম: মশারী, মশা প্রতিরোধী পদার্থ ব্যবহার এবং মশা নিধনের জন্য ওষুধ ছিটানো।
৩। জনসচেতনতা বৃদ্ধি: মশা প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রভাব এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি বড় স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রতি বছর বর্ষাকাল ও গ্রীষ্মকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চাপের মধ্যে ফেলে। ডেঙ্গুর কারণে বিশেষ করে শহর ও মহানগর এলাকায় বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে।
ডেঙ্গুর প্রতিরোধে সচেতনতা এবং সতর্কতার মাধ্যমে এর বিস্তার রোধ করা সম্ভব। জনগণের সচেতনতা, মশার প্রজনন স্থান নির্মূল এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের মাধ্যমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব। স্বাস্থ্য বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় এই রোগটির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।