রোহিঙ্গা সংকটের পেছনে রয়েছে দীর্ঘকাল ধরে চলা রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক সংঘাত, যা শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ভয়াবহ আকারে উদ্ভূত হয়। এই সংকটের ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা যায়:
১. রোহিঙ্গা সংকটের পটভূমি
রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের একটি মুসলিম জাতিগোষ্ঠী। মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক মানবাধিকার দীর্ঘকাল ধরে অস্বীকার করা হয়েছে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়, যা তাদেরকে ‘‘অবৈধ অভিবাসী’’ হিসেবে চিহ্নিত করে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘‘বাংলাদেশি’’ হিসেবে চিহ্নিত করে, যা তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা হ্রাস করেছে।
২. ২০১৭ সালের আগস্টের সামরিক অভিযানের সূত্রপাত
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু করে। এই অভিযানটির নাম ছিল “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন”, যা মূলত রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে দমন করার উদ্দেশ্যে চালানো হয়। জাতিগত নির্যাতন, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, গণধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতন ছিল এর অংশ। সেনাবাহিনী দাবি করে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি এসব ঘটনার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে এবং এটিকে “জাতিগত নিধন” বলে চিহ্নিত করেছে।
৩. রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা এবং শরণার্থী সংকট
এই সামরিক অভিযানের পর, প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন, বিশেষ করে কক্সবাজার জেলার উখিয়া এবং টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে। সেখানে তাদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। এই শিবিরগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির হিসেবে বিবেচিত হয়।
৪. বাংলাদেশের ভূমিকা এবং মানবিক সহায়তা
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা প্রদান করছে, তবে তাদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরগুলোতে পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয়। বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত স্থান নেই, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত, এবং মানবপাচারের মতো অপরাধও বাড়ছে। পাশাপাশি, স্থানীয় জনগণেরও সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, কারণ কক্সবাজার অঞ্চলের পরিবেশ, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
৫. ফিরিয়ে নেওয়ার চুক্তি এবং সীমিত সফলতা
২০১৭ সালের পর, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য চুক্তি সই করেছে, তবে এসব চুক্তির বাস্তবায়ন এখনও দুর্বল। প্রথমে মিয়ানমার বলেছিল যে তারা নিরাপত্তা ও শর্তসাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে, কিন্তু রোহিঙ্গারা তাদের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফেরত যেতে অস্বীকার করছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলি জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো মানে তাদেরকে আবারও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া।
৬. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি গুরুতর মানবাধিকার ও শরণার্থী সংকট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। ২০১৯ সালে, আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি জরুরি আদেশ দেয়, যেখানে তাদেরকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপের ফলে সামরিক জান্তা কিছু আন্তর্জাতিক পরিণতি মোকাবেলা করতে হয়েছে, তবে তারা এখনও কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
৭. মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২০১১ সালে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কিছু সময়ের জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল ছিল, তবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী আবারও ক্ষমতা দখল করে এবং একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। এই অভ্যুত্থান রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আরও বাধা সৃষ্টি করেছে, কারণ সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর পেছনে রয়েছে। সামরিক শাসন ক্ষমতায় আসার পর, আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া বা মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত করতে একেবারেই আগ্রহী নয়।
৮. মানবিক সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ
আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলি রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম চালাচ্ছে, কিন্তু নিরাপত্তা, তহবিলের অভাব, এবং শরণার্থীদের প্রতিকূল পরিবেশের কারণে তাদের কাজ কঠিন হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য দেশও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
৯. বর্তমান পরিস্থিতি
বর্তমানে, শরণার্থী শিবিরগুলোর পরিবেশ অস্থিতিশীল, এবং মানবিক সাহায্য প্রয়োজনের তুলনায় কম। জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্ভিক্ষ, এবং করোনা মহামারির মতো নতুন সংকটও রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। যদিও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে, তবুও সংকটের টেকসই সমাধান এখনো অধরা।
১০. সমাধানের সম্ভাবনা
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হতে পারে শুধু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং মৌলিক মানবাধিকার ফিরিয়ে দিয়ে, তাদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। কিন্তু, এর জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর শাসন এবং রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন দরকার, যা খুবই কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া।
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, চাপ এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের উপর নির্ভর করছে।
আয়নুল/