মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতে মানসিক স্বাস্থ্য হল এমন একটি সুতো যা আমাদের জীবনকে প্রতিটি দিক দিয়ে বুনছে। এটি আমাদের মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক সুস্থতার একটি সমন্বিত রুপ। আমরা কীভাবে চিন্তা করি, অনুভব করি এবং আচরণ করি তা প্রভাবিত করে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মানসিক স্বাস্থ্যকে একদিকে যেমন গুরুত্বহীন ভাবা হয়ে থাকে তেমনি মানসিক যেকোনো সমস্যাকে পাগলামির সাথে তুলনা করা হয়। জীবনে সাথে এর সম্পর্ক এর গভীর থাকা সত্ত্বেও, মানসিক স্বাস্থ্য এমন একটি ক্ষেত্র হিসাবে রয়ে গেছে যা প্রায়ই সামাজিক আলোচনায় ভুল বোঝা তেমনি মানসিক যেকোনো সমস্যাকে পাগলামির সাথে তুলনা করা যায় এবং অবমূল্যায়ন করা হয়। যাইহোক, সচেতনতা বাড়ার সাথে সাথে জোয়ারের পরিবর্তন হচ্ছে, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের আশেপাশে কথোপকথনগুলি আরও প্রচলিত এবং গঠনমূলক হয়ে উঠছে।
মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বলতে শুধুমাত্র মানসিক অসুস্থতার অনুপস্থিতি নয় বরং এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যক্তিরা তাদের সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক চাপ মোকাবেলা করতে পারে, উৎপাদনশীলভাবে কাজ করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়ে অবদান রাখতে পারে। শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য যেমন যত্ন এবং মনোযোগ প্রয়োজন, তেমনি আমাদের মানসিক স্বাস্থের যত্ন নেয়াও আবশ্যক।
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কেসআমরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি সেগুলো হলো কাজের চাপ, আর্থিক চাপ, সম্পর্কের গতিশীলতা, সামাজিক প্রত্যাশা এবং আঘাতজনিত অভিজ্ঞতা আমাদের মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়াও কোনো কেনো ক্ষেত্রে মানসিক অবসাদ এবং ডিপ্রেশন মানুষের মস্কিষ্কে প্রভাব ফেলে। আমাদের দেশের তরুনদের একটি বিরাট অংশ ডিপ্রেশনে ভুগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০১৭—এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৩০ কোটির বেশি মানুষ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। গত এক দশকে প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে রোগীর সংখ্যা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও ডব্লিউএইচও কর্তৃক পরিচালিত যৌথ জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭৪ লাখ। সম্প্রতি এমনও হচ্ছে মানসিক অবসাদ এবং ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে এর থেকে মুক্তি পেতে মানুষ আত্মহত্যার মত উপায় বেছে নিচ্ছে।
মানসিক স্বাস্থ্যের ফলাফলের উন্নতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাধাগুলির মধ্যে একটি হল মানসিক সমস্যা কারোও সাথে শেয়ার করতে না পারা। যার ফলে অনেককে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা সহায়তার পরিবর্তে নীরবতায় ভোগে। যাইহোক, শিক্ষা এবং খোলামেলা কথোপকথন এটি অনেকাংশে দূর করতে পারে এবং এমন পরিবেশকে লালন করতে পারে যেখানে ব্যক্তিরা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করার জন্য নিরাপদ বোধ করে।
সাপোর্ট সিস্টেমের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গেলে মানসিক সমস্যা সমাধানে আশেপাশের মানুষজনের সহযোগীতার মনোভাব পোষন একান্ত জরুরী। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারদের সহ সমর্থন মানসিক স্বাস্থ্যকে লালন করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের বোঝাপড়া, সহানুভূতি এবং উতৎসাহ একটি সুরক্ষা জাল তৈরি করে যা ব্যক্তিদের জীবনের চ্যালেঞ্জগুলি আরও কার্যকরভাবে গ্রহণ করার ক্ষমতা দেয়।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া একটি গন্তব্য নয় বরং একটি ক্রমাগত যাত্রা যার জন্য প্রয়োজন সমবেদনা, বোঝাপড়া এবং সক্রিয় প্রচেষ্টা। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং পদ্ধতিগত পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন করে, আমরা এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে পারি যেখানে মানসিক সুস্থতা মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে একই সাথে অগ্রাধিকার পাবে। মিলেমিশে আমরা বাধাগুলি ভেঙে দিতে পারি, বাধাঁ গুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি এবং এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারি যেখানে প্রত্যেকেরই পরিপূর্ণ এবং মানসিকভাবে সুস্থ জীবনযাপন করার সুযোগ রয়েছে।
এই যাত্রায়, আমাদের প্রত্যেকেরই একটি ভূমিকা আছে—সেই হোক একজন একজন সাধারন মানুষ অথবা মানসিক ভাবে সমস্যায় ভোগা কোনো ব্যাক্তি। কেউ যেন তাদের নিজস্ব মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা না করে। একসাথে কাজ করার মাধ্যমে, আমরা এমন একটি ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারি যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য কেবল কথোপকথনের বিষয় নয় বরং সবার জন্য মঙ্গলের ভিত্তি হবে পাশাপাশি সকলেই নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকবে।