দেশের ভূমিজদের প্রথম ছেলেটি উচ্চশিক্ষায় জার্মানি যাচ্ছে
রাজন হোসেন তৌফিকুল মৌলভীবাজারঃ
গাছগাছালিতে ভরা বাড়ি। দুটি মাত্র মাটির ঘর। উঠানটাও খুব সুন্দর করে লেপা। এক পাশে ফুল, অন্য পাশে তুলসী, পেঁপে আর লেবুগাছ।
বেশ সুনসান। ইতিউতি তাকিয়ে কাউকে পাওয়া গেল না। মোবাইলে নেটওয়ার্কও নেই যে কল দেব।
এক প্রতিবেশীকে বললাম, অঞ্জনরা কই বলতে পারেন? এখন তো ঘরে থাকার কথা না।
মনে হয় ক্ষেতে কাম করছে। ওই দিকে দ্যাখো।অঞ্জনের নাগাল পাওয়া গেল বাড়ির উত্তর পাশের এক জমিতে। মা-বাবার সঙ্গে আমনের চারা রোপণ করছিলেন।
হাসিমুখে বললেন, ‘তলব (মজুরি) দেয় না বলে অনেক দিন ধরে বাগানের কাজ বন্ধ। বাঁচতে তো হবে। তাই ধানের চারা রোপণ করছি আমরা।
শুধু এখন নয়, ঈদ, পূজা কিংবা যেকোনো ছুটিতে বাড়িতে এলেই কাজে নেমে পড়েন অঞ্জন। এতে সংসারের অভাব যদি একটু ঘোচে।
২২ ডিসেম্বর বিকেলে নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেছিলেন অঞ্জন। এই পোস্টের নিচে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে অসংখ্য মানুষ। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের জবাবে একটু হাসলেন অঞ্জন। বললেন, ‘একটা সুখবর আছে। সেদিন আমার স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষ হয়েছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার স্বপ্ন অনেক দিনের। মাস্টার্স পরীক্ষার আগেই আবেদন করেছিলাম। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি।
অঞ্জনের খুশি হওয়ার বহু কারণ আছে। বাংলাদেশে তাঁর আগে ভূমিজ সম্প্রদায়ের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রাখেনি। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র তিনি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ভূমিজদের প্রথম সন্তান হিসেবে স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করলেন অঞ্জন ভূমিজ। বাংলাদেশের বাইরে পড়তে যাওয়া এই জনগোষ্ঠীর প্রথম ব্যক্তিও তিনি।
ভূমিজ মানে ভূমির সন্তান। এদের আদি নিবাস ভারতের বিহারে। বিশ শতকের প্রথম দিকে তারা সিলেট অঞ্চলে আসে। এখানকার চা-বাগানে কাজ শুরু করে। বর্তমানে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় বাস করছে। দেশে ভূমিজদের সংখ্যা হাজার তিনেক।
মায়ের উৎসাহে পড়াশোনা:
মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলার ফুলতলা চা-বাগানে জন্ম তাঁর। বাবা অমৃত সিং, মা রতনমণি সিং। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়।
মা-বাবা দুজনই চা শ্রমিক। দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরি। অঞ্জনকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন তাঁর জ্যাঠা নিবারণ। শুরুর দিকে অমৃত সিং বলতেন, ‘লেখাপড়া করে কী করবি, একদিন তো বাগানের কলম কাটবি।’কিন্তু নিজে ‘কলম কাটলে’ও অঞ্জনের মা চাইতেন ছেলে যেন পড়াশোনা করে বাবুদের পাশে দাঁড়ায়। বলতেন, ‘বাবা লেখাপড়া কর, নিজের পায়ে দাঁড়া। তর বাপের যে রুজি, ওইটা দিয়ে সংসার চলে না।
চা-বাগানের বেশির ভাগ শিশুর শৈশব বলতে মার্বেল খেলা, গুটি খেলা বা আড্ডাবাজি। আরেকটু বড় হলে পাতা তোলায় নাম লেখানো। পড়ালেখা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই কারো। কিন্তু রতনমণি সিং খুব করে বোঝাতেন ছেলেকে। তবু প্রায়ই স্কুল কামাই করে মার্বেল খেলত ছোট্ট অঞ্জু। একদিন ভীষণ রাগ হলো মায়ের। অঞ্জনকে রাস্তা থেকে ধরে আনলেন। চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললেন, ‘দেখ বাবা, তোর জন্য এত কষ্ট করছি। স্কুল কামাই করলে তো বৃত্তি পাবি না। খাতা-কলম কিনবি কিভাবে?’
তখন মাসে দেড় শ টাকা বৃত্তি পেতেন অঞ্জন। টাকাটা খুব দরকার ছিল। কারণ তাদের সংসারে কেবল নাই আর নাই।
মায়ের সঙ্গে খাসিয়াপুঞ্জিতে:
কখনো স্যান্ডেল পরে স্কুলে যাওয়ার ‘সৌভাগ্য’ হয়নি অঞ্জনের। প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হলেন ফুলতলা বশির উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে। হাই স্কুলে মাসিক বেতন দিতে হতো। তখন তাঁর মা সকালে চা-বাগান আর বিকেলে খাসিয়াপুঞ্জিতে কাজ করতেন। সেখানে ৪০ টাকা মজুরি। ছুটির দিনে তাঁর সঙ্গে যেতেন অঞ্জন। ৩০ টাকা মজুরি মিলত। এ নিয়ে সহপাঠীদের কেউ কেউ তাঁকে ‘বাগানি, লেবার ইত্যাদি বলে খেপাত।
মন ভেঙে গেল:
তবে শিক্ষকদের অপমান হজম করতে কষ্ট হতো অঞ্জনের। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় দেখতেন, স্যাররা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের ল্যাবে নিয়ে যাচ্ছেন। তখন থেকে মনের কোণে স্বপ্ন পুষতেন—আমিও সায়েন্সে পড়ব। ওই রুমে ঢুকব।
নবম শ্রেণিতে ঠিকই বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন। একদিন স্যার জানতে চাইলেন, তোমরা কে কে সায়েন্স নিয়েছ? অনেকের সঙ্গে অঞ্জনও হাত তুললেন। স্যার কী মনে করে রেগে অঞ্জনকে বললেন ‘বর্গের বেসিক সূত্র বলো?
ঘাবড়ে গিয়ে মান নির্ণয়ের সূত্র বলে ফেললেন অঞ্জন। স্যার এসে কষে চড় বসিয়ে দিলেন তাঁর গালে! বললেন, ‘চা শ্রমিকের পোলা আইছে সায়েন্সে পড়তে!
আরো কয়েকজন শিক্ষকও বিমাতাসুলভ আচরণ করতেন। মন ভেঙে গিয়েছিল অঞ্জনের। ফল প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় রসায়নে পঞ্চাশে মাত্র দুই।
প্রধান শিক্ষক ডেকে নিয়ে বললেন, তোর দ্বারা হবে না। পাঁচ হাজার টাকা দিতে পারবি?
বোর্ডে গিয়ে সায়েন্স থেকে তোর নামটা বাদ দেব। মাথা নিচু করে চুপ রইলেন অঞ্জন। এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেই ২০১৪ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৪.১৩ পেলেন।
পরের গন্তব্য তৈয়বুন্নেছা খানম সরকারি কলেজ। বাসা থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে। কলেজজীবন কেটেছে চা-বাগানের আত্মীয়দের বাসায় থেকে। তাদের অবস্থাও ভালো না। কখনো কাপনাপাহাড়, কখনো সোনারপা চা-বাগান, শেষে ছিলেন ধামাই চা-বাগানে। প্রতি সপ্তাহে বাসা থেকে চাল, সবজি ইত্যাদি নিয়ে যেতেন। পদার্থ, রসায়নের জন্য প্রাইভেট পড়তেই হতো। বাবা ঋণ নিয়ে প্রাইভেটের ফি দিতেন। ২০১৬ সালে জিপিএ ৩.৯২ নিয়ে এইচএসসি পাস করলেন।
ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে:
প্রথমবার ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সুযোগ মেলেনি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন যে করেই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া লাগবে। দ্বিতীয়বার আদাজল খেয়ে নামলেন। বাসায় থেকেই প্রস্তুতি চলল। হতাশায় প্রায়ই নীরবে চোখের জল ফেলতেন। মা বোঝাতেন। বাবা একদিন পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘আবার পরীক্ষা দে। ভিক্ষা করে হলেও তোকে পড়াব।
পরেরবার সুযোগ পেলেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাওলানা ভাসানীতে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলেন। বাগানের এক বাবুর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার নিলেন তাঁর বাবা। ভাইভার সময় তৎকালীন প্রক্টর সিরাজুল ইসলাম সব জেনে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। বন্ধুরা বই-খাতা, জুতা, এমনকি পোশাকও কিনে দিয়েছিল। এলাকার কাওছার ভাই অঞ্জনের জন্য একটা টিউশনি ঠিক করে দিয়েছিলেন। এভাবেই কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন।
কাজকে ভালোবেসেছেন:
একটা সময় তিনটি টিউশনি করতেন। একদিন কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের নিজের জীবনকাহিনি বলে ফেলেন। তিনি ভূমিজ সম্প্রদায়ের সন্তান, চা-বাগানে বড় হয়েছেন—এটা সহজভাবে নেননি অভিভাবকরা, পরে একে একে তিনটি টিউশনিই চলে গেল। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে লাগলেন। অঞ্জনের এক বন্ধু ক্যাম্পাসে নাশতা সরবরাহ করতেন। একদিন সেই বন্ধুর কাছে গিয়ে বললেন, আমি তোর কাজে সহযোগিতা করব। না করিস না। পরে হলের রুমে রুমে খাবার পৌঁছে দিতে লাগলেন। দৈনিক ১০০ টাকা করে পেতেন।
ঈদ-পূজাসহ ছুটিতে বাড়ি গেলে খাসিয়াপুঞ্জিতে কাজ করতেন। কখনো অন্যের জমির ধান কেটে দিতেন। মাটি কাটা কিংবা ধান রোপণের কাজও করেছেন। করোনার সময় লোকের পোষা প্রাণীর জন্য পাহাড় থেকে কচু এনে দিতেন। এভাবে নিজের পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন।
এবার আইনস্টাইনের দেশে:
এত কষ্টের মধ্যে বড় হলেও নিজেকে নিয়ে পড়ে থাকেননি অঞ্জন। চেয়েছেন নিজ সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের সংগঠিত করতে। তাদের জন্য ফ্রি অনলাইন কোচিংও চালু করেছেন। তাঁর দেখাদেখি এখন ভূমিজ সম্প্রদায়ের আরো ৯ জন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। যতটুকু সম্ভব তাঁদের পাশে থাকার চেষ্টা করেন অঞ্জন। স্বপ্ন দেখেন, একদিন তাঁর মতো ভূমিজ সন্তানদের সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ভূমিজ সম্প্রদায়ের (জুড়ি ভ্যালি) সভাপতি মহাদেব ভূমিজ বলেন, দেশে ভূমিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া প্রথম ব্যক্তি অঞ্জন। তাঁর দেখাদেখি সামনে আরো অনেকে অনুপ্রাণিত হবে।
গত ডিসেম্বরেই স্নাতকোত্তর সম্পন্ন হয়েছে অঞ্জনের। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে কয়েক মাসের মধ্যে জার্মানির উদ্দেশে উড়াল দেওয়ার কথা অঞ্জনের। সেখানকার টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ডার্মস্ট্যাডে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স বিষয়ে পড়বেন তিনি।
তাঁর মা রতনমণি সিং বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে পড়াইছি ওরে। এখন দেশের কাজে লাগলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হবে।’ বাবা অমৃত সিং বললেন, অঞ্জনের জন্য আমরা গর্বিত। শুধু নিজের জন্য নয়, চাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে দশের উপকার করবে সে।
অঞ্জন বললেন, ‘আরো অনেককে সামনে এগিয়ে নিতে চাই। আমাদের বিডিএন ৭১ ইউটিউব ঘুরে আসুন। আরো খবর পড়ুন রাবি রিপোর্টার্স ইউনিটির দুই যুগ পূর্তি উৎসব ২২ ফেব্রুয়ারি।