নওগাঁয় সমবায় সমিতির খপ্পরে দিনে দিনে নিঃস্ব হচ্ছেন হাজারো মানুষ। এক বছড়ে লাপাত্তা হয়েছেন ৮ সমবায় ও ঋনদান সমিতি। এর মাঝে আরও দোয়েল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি গত ২৫ অক্টোবর রাতারাতি বন্ধ করে গ্রাহকদের প্রায় অর্ধকোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যান উদ্যোক্তারা। দোয়েল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতিতে টাকা রেখে সঞ্চিত টাকা খুইয়েছেন নওগাঁ সদর, রাণীনগর, আত্রাই ও বদলগাছী উপজেলার প্রায় হাজার গ্রাহক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু দোয়েল সমিতিই নয়; গ্রাহকদের টাকা নিয়ে চলতি বছর নওগাঁয় জেলায় আটটি সমবায় সমিতির উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তারা গ্রাহকের আমানতের টাকা ফেরত না দিয়ে হঠাৎ করে কার্যক্রম বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে গেছেন। এতে দরিদ্র মানুষ সমবায় সমিতির মাধ্যমে স্ববলম্বী হওয়ার বদলে নিঃস্ব হচ্ছে। ভাঙছে তাঁদের স্বপ্ন। এসব সমবায় সমিতির উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অন্তত পাঁচ হাজার গ্রাহকের অর্ধ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এরপও গ্রাহকদের লাগাতার আন্দোলন ও মামলা করেও তাদের সঞ্চিত অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না।
এবছর শুরুতেই উধাও হয়, নওগাঁ সদর উপজেলায় সুরমা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। এরপর একে একে ডলফিন সমবায় সমিতি, জগৎসিংহপুর সূর্যমুখী বহুমুখী উন্নয়ন সমবায় সমিতি, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন ও মেঘনা সেভিংস এন্ড ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মহাদেবপুর উপজেলার ব্যতিক্রম ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড এবং মান্দা উপজেলার আল আরাফাহ সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড।
নওগাঁ জেলা সমবায় সমিতি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নওগাঁর ১১টি উপজেলায় নিবন্ধিত সমবায় সমিতির সংখ্যা রয়েছে ১ হাজার ৬২০টি। এর মাধ্যমে মাঠে ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন অন্তত ৪৫০টি সমিতি।
নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম (৫০)চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে কয়েক ধাপে পুকুরের মাছ, খেতের ফসল বিক্রি করে তিল তিল করে ১৬ লাখ টাকা জমিয়েছিলেন দোয়েল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সমিতিতে। ৮ মাসের লভ্যাংশসহ তা বেড়ে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা হয় তার। এর মাঝে গত ২৫ অক্টোবর রাতারাতি বন্ধ করে পালিয়ে যায় দোয়েল সমবায় সমিতির পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমসহ সকল উদ্দোক্তা। এতে পুরোদমে নিঃস্ব হয়েছে তিনি।
দোয়েল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেনকে পুলিশ গত বুধবার (৩০ অক্টোবর) রাতে আটক করে। সেখানে তিনি জানান, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের পর থেকে সমিতির সদস্যরা সবাই একসঙ্গে আমানতের টাকা ফেরত চাওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যাই। গ্রাহকদের কাছ থেকে মাসিক ও স্থায়ী আমানত হিসেবে যে টাকা আমার নেওয়া আছে তার মধ্যে অর্ধেকটাই মাঠে ঋন দেওয়া আছে। সেই টাকা তুলতে না পারায় সদস্যদের টাকা ফেরত দিতে পারছি না। কিন্তু সদস্যরা তা মানতে চান না। টাকা না পেলে অনেকেই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। নিরাপত্তার কারণে গত শুক্রবারে আত্মগোপনে চলে যাই। তবে প্রশাসন আমাকে নিরাপত্তা দিলে আমার সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের সব টাকা ফেরত দেব।
ভুক্তভোগীরা জানান, জেলা ও উপজেলা কার্যালয় থেকে সমবায় সমিতি হিসেবে নিবন্ধন নেওয়ার পর থেকে সমতির উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তারা সাধারণ মানুষদের বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে। তারা অবৈধভাবে ব্যাংকের আদলে মাসিক ও বার্ষিক আমানত প্রকল্প, স্থায়ী বিনিয়োগ ও স্থায়ী আমানত নামে বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে টাকা রাখতে শুরু করে। টাকা জমা রেখে গ্রাহকদের প্রতি মাসে অধিক লাভে মুনাফা দিতে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। ধীরে ধীরে সমিতির গ্রাহকসংখ্যা ও আমানতের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এভাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে গ্রাহকদের আমানতের টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায়।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা খোন্দকার মনিরুল ইসলামের কাছে গ্রাহকের টাকা সমিতির লাপাত্তা হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নওগাঁতে সাড়ে চারশোটির মতো ঋণদানকারী সমিতির কার্যক্রম বর্তমানে চলমান আছে। যেগুলো সমবায় সমিতি সম্প্রতি গ্রাহকদের সঞ্চয়ের টাকা ফেরত না দিয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে তাঁদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সাপেক্ষে এসব সমিতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন এবং ভবিষ্যতে যেনো কোনো সমবায় সমিতি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চলতে না পারে সে ব্যাপারে মনিটরিং কার্যক্রম বাড়ানো হবে বলেও জানান তিনি।