মোঃ আয়নুল ইসলামঃ প্রতি বছর ৮ই মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবছর যথাযোগ্য সম্মানের সাথে এই দিনটি উদযাপিত হয়। ১৯১০ সালের ৮ই মার্চ ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে জার্মানের সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করেন। এরপর ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ই মার্চকে “আন্তর্জাতিক নারী দিবস” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।এরই ধারাবাহিকতায় সারা বিশ্বে দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে।
এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় “অধিকার, সমতা,ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন”।
নারী দিবসে বলছি একজন সফল নারীর গল্প। তিনি রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডীন ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সূচনা আখতার। শিক্ষকতার পাশাপাশি যুক্ত রয়েছেন বেশকিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সাথে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নানা প্রসঙ্গে বিডিএন৭১ এর বিশেষ প্রতিনিধি মোঃ আয়নুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশটুকু নিচে তুলে ধরা হল-
বিডিএন৭১ঃ আপনার জন্মস্থান, বেড়ে উঠা,লেখাপড়া,কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই?
সূচনা আখতারঃ ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার চরদেহুন্দা গ্রামে। নরসুন্দা নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠা কৃষিজমির অবারিত রত্নভান্ডার সমৃদ্ধ ও সবুজে ঘেরা অপরুপ গ্রামে আমার ছোটবেলা কাটে। প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত গ্রামে পড়ার সুবাদে আমি পেয়েছি প্রকৃতির সান্নিধ্য, দেখেছি মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই আর বড় হয়েছি সহজ-সরল মানুষগুলোর নিঃশর্ত ভালোবাসায়।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশুনা করি কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত এস ভি সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পৌর মহিলা কলেজ থেকে।
২০০৬-২০০৭ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হই। সেখান থেকে বিবিএ এবং এইচ.আর.এম. বিষয়ে এমবিএ ডিগ্রী অর্জন করি। পরবর্তীতে আমি আমার প্রথম কর্মজীবন শুরু করি ঈশাঁখা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এর বিজনেস ফ্যাকাল্টির প্রভাষক হিসেবে। সেখানে চাকরিরত থাকাকালীন আমি ২০১৪-২০১৫ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির অধীনে এম.ফিল. এ ভর্তি হই এবং ২০২১ সালে সনদপ্রাপ্ত হই।
২০১৫ সালের ১৪ অক্টোবর আমি রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করি এবং বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছি। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই পাঠদানের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। তার মধ্যে ছাত্রী হলের হাউজ টিউটর, সহকারী প্রক্টর, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, হলের প্রভোষ্ট, আই.কিউ.এ.সি. সেলের অতিরিক্ত পরিচালক এবং ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডীন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বেশকিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছি ছাত্র জীবন থেকেই।
বিডিএন৭১ঃ আপনার ছেলেবেলার কোনো মধুর স্মৃতি, যা আপনাকে আজও আলোড়িত করে। সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
সূচনা আখতারঃ ছোটবেলার একটা স্মৃতি আমাকে এখনো আলোড়িত করে, কিন্তু, সেটা ঠিক মধুর না। একবার এক ঝড়ের কবলে আটকে পরেছিলাম আমার নানাভাই সহ। রাস্তার মাঝে হঠাৎ ঝড়ের আক্রমনে আশ্রয় নিয়েছিলাম ছোট একটা নড়বড়ে যাত্রী ছাউনি/কোন একটা চালা ঘর যার তিনটা বেড়াই ঝড়ে উড়িয়ে নিয়েছিলো। প্রচন্ড ঝড়ের মুখে ঐ ছাউনি আমাদের কে রক্ষা করতে পারবেনা বুঝতে পেরে সুযোগ বুঝে নানাভাই আমাদের কে নিয়ে কিছুটা দূরের একটা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অনেকক্ষন ঝড়ের তাণ্ডব চলার পর আমরা যখন আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পুনরায় যাত্রা শুরু করেছিলাম তখন দেখেছিলাম চারপাশে অনেক বড় বড় গাছ,বাড়িঘর ভেঙে পরে আছে। সবকিছু তছনছ করে দেওয়া সেই ঝড়ের পরেও ঐ নড়বড়ে ছাউনি ঘরটি কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমার শিশু মন সেদিন নানা ভাইকে অনেক প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু এই স্মৃতি আমার আজও মনে আছে,যখনই সেই রাস্তা দিয়ে যাই তখনই সেই ঝড়ের কথা আমার মনে পড়ে। সেদিন না বুঝতে পারলেও আজ আমি বুঝতে পারি কেন সেই ঘরটি সেদিন টিকেছিলো। আর তা হলো- “Survival of the fittest”- যা আমার জীবনের এই যাত্রায় প্রতিনিয়তই আমাকে অনুপ্রেরণা যোগায়।
বিডিএন৭১ঃ একজন নারীর সফলতার মূলে কোন অনুষঙ্গগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে? সেক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতা কতখানি দরকার বলে আপনি মনে করেন?
সূচনা আখতারঃ একজন নারীর সফলতার মূলে যে অনুষঙ্গগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- তার নিজের মধ্যে ধারন করা অদম্য ইচ্ছাশক্তি, প্রতিকূলতা কে জয় করার মত সাহস, আর নিজের প্রতি বিশ্বাস। আর আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন মেয়ের মধ্যে এই সমস্ত বৈশিষ্ট ধারন করার জন্য পরিবারের সহযোগিতার কোন বিকল্প নেই বলে আমি মনে করি।
বিডিএন৭১ঃ আপনার আজকের সফলতার পেছনে অবশ্যই বাবা-মায়ের ভূমিকা রয়েছে। তাদের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
সূচনা আখতারঃ আমি আজও সফল কিনা সেটি জানিনা, তবে আমার আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে আমার বাবা-মায়ের ভূমিকা হয়ত লিখেও শেষ করতে পারবো না। আমার বাবা ছিলেন সময়ের সাথে চলা একজন প্রগতিশীল মানুষ। পড়াশোনায় কোন উচ্চতর ডিগ্রী না থাকলেও তিনি আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলে বড় জায়গায় পড়ার,সকল অবস্থায় সাহসের সাথে মোকাবিলা করার আর যাই করি যেন দৃঢ়তার সাথে ঠিক কে ঠিক আর ভুল তে ভুল বলতে পারি।
আমার মা একজন গৃহিনী-কিন্তু তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন সংসার-বাচ্চা সামলানো ছাড়াও মেয়েদের নিজেদের জীবনে আরও অনেক কিছু করার আছে। এখন পর্যন্ত তার জন্যই আমার বাচ্চাদের জন্য আমাকে চিন্তা করতে হয় না, সেজন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো দায়িত্ব পালনের সাহস করতে পারছি। এর বাহিরে আমার স্বামী,শ্বশুরবাড়ি,আত্মীয়স্বজন, ছোটভাই সবাইকে আমি সর্বাবস্থায় আমার পাশে পেয়েছি।
বিডিএন৭১ঃ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আপনি দায়িত্ব পালন করছেন। এই অবস্থানে আসার শুরুটা আপনার কীভাবে হয়েছিল?
সূচনা আখতারঃ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বর্তমান অবস্থান পর্যন্ত আসার যাত্রাটা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু আমার স্বপ্নটা ছোটবেলা থেকে এমন ছিলো না। এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও শিক্ষক হতে হবে, ভালো রেজাল্ট করতে হবে এমনটা ভাবিনি। যখন চাকরি জীবন শুরু করি তখন একবার নিজের সক্ষমতা যাচাই করতে চেয়েছিলাম শিক্ষক হিসবে। কিছুদিন পর দেখলাম ক্লাসরুমে পড়ানোটা আমাকে আনন্দ দিচ্ছে, শিক্ষার্থীদের সাথে আমার ছাত্রজীবনকে আবার উপলব্ধি করার সুযোগ পাচ্ছি আর সর্বোপরি কর্মজীবনেও আমার নিজস্বতা নিয়ে কাজ করার এই সহজ প্লাটফর্মটা তখন সিরিয়াস ভাবেই আমার জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠলো। এম.ফিল. এ ভর্তি হওয়ার পর বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিতে থাকলাম, তারপর একদিন সৃষ্টিকর্তা রিযিক লিখে দিলেন-রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে এ যাত্রায় আমাকে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। নিজের পরিচিত পরিবেশ, সমমনা পরিজনের বাইরে এসে আমাকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে আমার প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তির জন্যই হয়ত।
বিডিএন৭১ঃ এই পথ পাড়ি দিতে কোনো বাঁধার সম্মুখীন কি হয়েছেন?
সূচনা আখতারঃ যদি বলি কি কি বাধার সম্মুখীন হয়েছি তাহলে তা হয়ত অনেকের জন্য ব্যক্তিগত আক্রমন হতে পারে অথবা প্রাতিষ্ঠানিক অবমাননা হতে পারে তাই সেদিকে যাচ্ছি না। তবে সত্যি একটা কথা বলতে চাই, “যে মেয়েটা সমান রাস্তায় হেঁটে বড় হয়েছে সে যখন উচুনিচু রাস্তায় সমান তালে হাঁটে- বুঝতে হবে তার মধ্যে অজেয়কে জয় করার মত অদম্য স্পৃহা রয়েছে।” আমি সৃষ্টিকর্তার দরবারে কৃতজ্ঞ তিনি আমার মধ্যে এই স্পৃহাটুকু দিয়েছেন। আর প্রার্থনা করি যেন সর্বাবস্থায় তিনি আমার সম্মান রক্ষা করেন।
বিডিএন৭১ঃ আপনার অবসর কীভাবে কাটে, আপনার শখ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
সূচনা আখতারঃ অবসর কাটে নেটওয়ার্কিং করে। কাজের সময়ে আত্মীয়স্বজনের খোজ নিতে পারিনা, চাইলেই সকল পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারিনা। তাই অবসর সময়ে তার কম্পেনসেশন দেওয়ার চেষ্টা করি।
আর শখ- রান্না করা, ঘুরে বেড়ানো, মিউজিক শোনা।
বিডিএন৭১ঃ নারী দিবস নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
আন্তজাতিক নারী দিবস হিসেবে ৮ই মার্চ বিশ্বব্যাপী নানান প্রতিপাদ্যে প্রতিবছর পালিত হয় এই দিসটি। কিন্তু তার, পরই আবার সবকিছু, যথারীতি চলে । এই জিনিস টুকু আমার ঠিক যথার্থ মনে হয় না। প্রতিটি ধর্মেই নারী উচ্চ আসনে থাকলেও বিভিন্ন সামাজিক,রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নারী তার যথাযোগ্য মর্যাদা পায় না- এটাই চরম বাস্তবতা। আমি বলছি না নারী পুরুষ সমান, কিন্তু একজন নারী তার নিজের শরীরে আর একটি প্রাণ ধারন করতে পারে- সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এই মর্যাদার যদি আমরা সঠিক উপলব্ধি করতে পারতাম। তাহলে আজকে নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য এত লড়াই, আন্দোলন করতে হতো না।
এই নারী দিবসে আমি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি সবাইকে এবং আহ্বান জানাচ্ছি, শুধু একটি দিনে সীমাবদ্ধ না থেকে বছরের অন্যান্য দিনগুলোতেও আমরা যেন একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই, সহমর্মী হই এবং সংবেদনশীল হয়ে ঘরে বাইরে কাজ করে যাই।