নারী দিবস শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি নারী অধিকার, নিরাপত্তা ও সমতার দাবির প্রতীক। সমাজে নারীরা নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও এখনো বৈষম্য, সহিংসতা ও স্বীকৃতির সংকটে ভুগছেন। প্রতিদিন কোনো না কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অবহেলিত হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নারীদের এই বাস্তবতা ও পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শিক্ষার্থীরা তাদের ভাবনা তুলে ধরেছেন।
নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা, প্রয়োজন সচেতনতা
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগামী ভূমিকা আজ সুস্পষ্ট। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ নানা খাতে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।
তবে এখনো কিছু মানুষ নারীদের স্বাধীনতার কথা বলে উল্টো তাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়। ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে সামাজিক ও মানসিকভাবে নারীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়, যা নারীর প্রকৃত অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নারীদের এগিয়ে যাওয়ার এই ধারা অব্যাহত রাখতে এবং সমাজে তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিশেষভাবে সচেতন হওয়া জরুরি। নারী দিবসে শুধু শুভেচ্ছা নয়, নারীর অধিকার রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণই হতে পারে প্রকৃত অগ্রগতির চাবিকাঠি।
মো: রাকিব সরদার
শিক্ষার্থী, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়
নারী দিবসে শুভেচ্ছা নয়, চাই নিরাপত্তা ও বিচার
প্রতি বছর নারী দিবসে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা বলা হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও কি শিশু থেকে বৃদ্ধা—কেউ নিরাপদ? দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন কোনো না কোনো নারী নির্যাতিত হচ্ছেন। নারীরা যখন ঘর থেকে বের হন, তখন ভয় নিয়ে বের হতে হয়—রাস্তায় কেউ বিরক্ত করবে না তো? বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে কেউ বাজে আচরণ করবে না তো? রাতে ফিরতে দেরি হলে চেনা শহরটাও যেন অচেনা হয়ে যায়।
নারীরা শুধু প্রশংসা বা শুভেচ্ছা চান না, তারা নিরাপত্তা চান। তারা ন্যায়বিচার চান। নারীদের প্রতি সহিংসতার শাস্তি হতে হবে দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক, যাতে কেউ আর নারীর দিকে খারাপ চোখে তাকানোর সাহস না পায়। নারী দিবস তখনই সার্থক হবে, যখন নারীরা শিশু থেকে বৃদ্ধা—সবাই নিরাপদ থাকবেন। শুধু কথায় নয়, দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। নারীরা ভয় পেতে চান না, তারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চান।
খোশবুবা আলম ব্রতী
শিক্ষার্থী, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়
ঘরের নারীর অবদান কতটা স্বীকৃত?
নারী শুধু পরিবারের সদস্য নন, তিনি পরিবারের মূল শক্তি। মা, স্ত্রী, বোন বা কন্যা—যে ভূমিকাতেই থাকুন না কেন, তার ভালোবাসা, যত্ন ও মেধায় প্রতিদিন গড়ে ওঠে একটি পরিবার। তবে তার শ্রম ও অবদান কি যথাযথ স্বীকৃতি পায়?
একজন নারী শুধু ঘর সাজান না, বরং তার উপস্থিতিতেই একটি বাড়ি হয়ে ওঠে ভালোবাসার আশ্রয়। তার যত্নে সকালের চা হয়ে ওঠে বিশেষ, তার রান্নায় লুকিয়ে থাকে মমতার স্বাদ, তার স্পর্শেই ঘর হয়ে ওঠে শান্তির নীড়। কিন্তু ঘরের কাজকে এখনো সমাজ ‘কর্ম’ হিসেবে গণ্য করে না।
এখানেই শেষ নয়, নারী শুধুই গৃহস্থালির দায়িত্ব পালন করেন না, তিনি পরিবারের সম্পর্কগুলো দৃঢ় রাখেন, মানসিক শক্তি জোগান, সন্তানদের মানুষ করেন এবং অনেক সময় বাইরের দায়িত্বও সামলান। অথচ এই নিঃস্বার্থ শ্রমের মূল্যায়ন হয় না, তার অবদান থেকে যায় উপেক্ষিত। নারী দিবসে তাই শুধু কর্মজীবী নারীর কথা নয়, সেই ঘরের নারীর কথাও বলা দরকার, যিনি প্রতিদিন অক্লান্ত পরিশ্রমে পরিবারকে আগলে রাখেন। সমাজের মূল কাঠামো তৈরিতে যাদের অবদান অপরিসীম, তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানানোই হোক নারী দিবসের মূল বার্তা।
হামিদ হোছাইন আজাদ
শিক্ষার্থী, অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিজ্ঞায় হোক পরিবর্তনের শুরু
নারী দিবস মানে শুধু একটি দিনের উদযাপন নয়, এটি নারীর শক্তি, স্বাধীনতা ও সমান অধিকারের প্রতীক। তবে এই আদর্শ কতটা বাস্তবায়িত? নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে শুধু আলোচনা করলেই হবে না, এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হবে যেখানে তারা নির্ভয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র কী বলছে? দেশে এখনো নারীরা নিরাপত্তাহীনতা, সহিংসতা ও হয়রানির শিকার। রাস্তায় বের হলে আতঙ্ক, কর্মক্ষেত্রে অসমতা, ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত লড়াই। নারী হয়ে জন্মানো যেন এক অপরাধ—ছোটবেলা থেকেই বিধিনিষেধ আর সামাজিক চাপের শিকার হতে হয়। “মেয়েরা এটা করতে নেই, ওটা বলা উচিত না”—এই কথাগুলো শুনতে শুনতেই বড় হয় তারা। কর্মজীবনে গেলে নতুন সমালোচনা—“সংসার সামলাও,” “সন্তান নাও,” “ভালো মা হতে হবে।” এরপর রাস্তায় বের হলে নিরাপত্তার প্রশ্ন, হয়রানির শিকার হলে পোশাকের দোষ, প্রতিবাদ করলে রাগী হওয়ার তিরস্কার!
সমাজ যেন নারীর জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ঠিক করে দিতে চায়, অথচ বাস্তবতা হলো—নারীও মানুষ, কোনো অতিমানব নয়! প্রতিদিন বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক দ্বৈত মানসিকতার শিকার হয়েও তারা এগিয়ে চলেছে, এটিই তাদের আসল শক্তি।
তাই নারী দিবসে শুধু ফুল ও শুভেচ্ছা নয়, প্রয়োজন বাস্তব নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, মানসিকতার পরিবর্তন এবং এমন এক সমাজ যেখানে নারীদের শুধু ‘সব পারতে’ হবে না, বরং তাদের ইচ্ছাকে সম্মান করা হবে।
মেহেরিন সুলতানা
শিক্ষার্থী, টেক্সটাইল ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়