ঢাকা, আসলেই কি আবৃত, নয়; প্রকৃতই মুক্ত বিহঙ্গ। সর্বদা বুড়িগঙ্গার জল প্রবাহ বয়ে চলে একাধারে মুক্তহৃদয়ে। এই জল প্রবাহকে কেন্দ্র করে গড়েছিল উঠেছিল বুড়িগঙ্গার উত্তরদিগন্তে ঢাকা। জল গড়িয়েছে, জন্ম নিয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য। পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্য, ব্যাপক প্রভাবশালী। সংস্কৃতি চর্চা, রাজনীতি চর্চার আঁতুড়ঘর ছিল পুরোনো ঢাকা। পুরোনো ঢাকার কয়েকটি অঞ্চল হলো; শাখারীবাজার, তাঁতিবাজার, বাংলাবাজার, সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, সোয়ারীঘাট, শ্যামপুর, নবাবপুর, বংশাল, টিকাটুলী, গোপীবাগ, সায়েদাবাদ, লক্ষ্মীবাজার, গেন্ডারিয়া, ওয়ারি, নারিন্দা, পোস্তগোলা, লালবাগ, মৌলভীবাজার, চকবাজার ও বকশিবাজার। এ অঞ্চলগুলোই সাধারণতঃ বাংলাদেশের সূতিকাগার। আর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া হলো, মূল ল্যাম্পপোস্ট। পুরোনো ঢাকায় বিকাশ ঘটেছে মানুষ অধিকার আদায়ের আন্দোলনের। আমরা হয়তো কল্পনাই করতে পারি না, পুরোনো ঢাকা বাংলাদেশ বিনির্মাণে কি অবদান রাখলো। অবদান তো রেখেছে, সেটা বুঝতে হলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্মকাহিনী বুঝতে হবে।
আওয়ামী লীগের জন্মসূত্র রয়েছে ঢাকার মোগলটুলিতে। এখানেই ১৫০ নম্বর শওকত মিয়ার (আলী) বাসভবনে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে স্বাধীনতার স্বাদ দেয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কবলে থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অনুভব করতে পারঙ্গম হচ্ছিল না। তখন পূর্ববঙ্গের তরুণরা সংগঠিত হতে থাকে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সংগঠনের দিকে নজর দিতে থাকে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের তত্ত্বাবধানে তরুণ কর্মীরা ঐ একশ’ পঞ্চাশ নম্বর বাড়িতে কয়েকটি প্রস্তুতিমূলক সভা করেন; রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে।
গোপীবাগ-সায়েদাবাগ-রামকৃষ্ণ মিশন-টিকাটুলীর অভ্যন্তরে কে এম দাস লেন। এই লেনেই অবস্থান রোজ গার্ডেন প্যালেসের। এটা প্রথমে নির্মাণ করেন ব্যবসায়ী ঋষিকেশ দাস। পরে প্রাসাদটি হাত বদল হয় কয়েক দফায়। ভবনটি এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় নথিপত্র ভিত্তিক তথ্য উল্লেখ রয়েছে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন টিকাটুলী এলাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেসে এক কর্মী সম্মেলনে গোড়াপত্তন হয় আওয়ামী লীগের। বলা যায়, এটাই আওয়ামী লীগের আদি নিবাস। এরপর নবাবপুর, সদরঘাট ও পুরানা পল্টনে দলীয় কার্যালয় ছিল। কালক্রমে পুরোনো ঢাকার গুলিস্তানে থিতু হয় আওয়ামী লীগ। গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে নবরূপে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় নির্মিত হয়েছে। লীগের সভাপতির কার্যালয় রয়েছে ধানমন্ডির ৩/এ-তে। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় রয়েছে তেজগাঁওয়ে।
রাজধানীতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি নিজস্ব ভূমিতে। তেমনিভাবে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যালয় থাকা অত্যাবশকীয়। কারণ প্রতিটি সংগঠনের কাজের জন্য নিদেনপক্ষে একটি কার্যালয় প্রয়োজন। ঢাকায় আওয়ামী লীগ নিজের ভূমির ওপর অন্তত তিনটি কার্যালয় করতে সক্ষম হয়েছে। তা অত্যাধুনিক। প্রযুক্তিনির্ভর।
দেশ ছেড়ে যাই দূরদেশে। নয়াদিল্লীর ২৪ আকবর রোডে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দপ্তর। এছাড়া রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে হেড কোর্য়ার্টার্স আছে। মহারাষ্ট্রের বোম্বাইতে ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর কংগ্রেসের প্রথম যে সাংগঠনিক অধিবেশন বসেছিল, সেটাও হয় একটি মহাবিদ্যালয়ের চত্বরে। তখন প্রথম সভাপতি হন উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতায় জন্মলাভ করেন। তিনি ব্যারিস্টার ও কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার আদি নিবাস ছিল হুগলী। এরপর নেহেরু-গান্ধীর প্রভাব বৃদ্ধি পায় কংগ্রেসে। কংগ্রেসের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল সমাজতন্ত্র, উদারতা ও লোকতন্ত্র।
১৯৫১ সালের ২১ অক্টোবর ভারতীয় জনসংঘ দিল্লীর একটি বিদ্যালয়ে গঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা প্রথম সভাপতি ডক্টর শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোক। ভারতীয় জনসংঘই পরবর্তীতে ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি) রূপ নেয়। এই বিজেপির প্রধান রাজনৈতিক কার্যালয় নয়া দিল্লীতে। এটার অবস্থান ৬-এ দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গ সড়কে। উত্তর প্রদেশের পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় জনসংঘ সৃষ্টিতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন। তার নামেই নামকরণ হয়েছে বারোখাম্বার অন্তর্গত মাতা সুন্দরী রেলওয়ে কলোনী এলাকার দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের নাম। ইন্টারনেটের সাহায্যে গুগল মানচিত্রে গেলে বিজেপির প্রধান কার্যালয় দেখা যায়। দৃষ্টি নন্দন ভবন। পরিপাটি। সাজানো গোছানো। এতেই বুঝা যায়, একটি দল কতোটা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। বিজেপি ভারতে ক্ষমতাসীন। অন্যদিকে পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
তদুপরি বিহারে বিজেপির নিজস্ব কার্যালয় রয়েছে। যেটা পাটনার ৮ নম্বর বীর চাঁদ প্যাটেল পথে অবস্থিত। কোলকাতায় বিজেপির দপ্তর ছয় নম্বর মুরলীধর সেন লেনে অবস্থিত।
শহীদ প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলীর ভুট্টোর হাত ধরে লাহোরে পাকিস্তানের পিপলস পার্টি (পিপিপি) ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর সংগঠিত হয়। এই দলেরও নিজস্ব ঢেরা রয়েছে। সেটা করাচিতে অবস্থিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ১৯৭৩ সালে প্রথম পাকিস্তানের নাগরিকদের সংবিধান উপহার দিতে সক্ষম হন ভুট্টো। পিপিপির ওয়েবসাইট ঘেঁটে তাদের অফিসের অবস্থান সম্পর্কে তেমন জানা যায় না।
ডন স্টিফেন সেনানায়েক আদিপুরুষ-কালপুরুষ। ডন স্টিফেন সেনানায়েক কালের সাক্ষী, তিনিই আদিপৌরুষ সিংহলের রাজনীতিতে। শ্রীলংকায় রাজনৈতিক দল গঠনে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। তার বিচক্ষণতায় গড়ে উঠে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি ১৯৪৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে। এটি ব্রিটিশ বিরোধী দল। রক্ষণশীল। শ্রীকোটা এলাকার শ্রী জয়াবর্ধনেপুরা কোটায় তাদেরও নিজস্ব কার্যালয় আছে। হাতি হচ্ছে তাদের দলীয় প্রতীক। এই দলের পুরোধা ব্যক্তিত্বরা ছিলেন সেনানায়েক, বন্দোরনায়েক, প্রেমাদাসা ও রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে।
ভারতীয় বংশোদ্ভুত তামিল জনগোষ্ঠী শ্রীলংকায় সিলন ওয়ার্কার্স কংগ্রেস গঠন করে। ১৯৩৯ সালে দলটি গঠিত হয়। কলম্বোতে এই দলেরও স্থায়ী কার্যালয় রয়েছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে সাত-সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে চোখ রাখি কানাডায়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর দল লিবারেল পার্টি। তাদের নিজস্ব জমিতে কার্যালয় নেই। যদিও লিবারেল পার্টির বয়স দেড়শ’ বছরের অধিক। অথচ ভাড়াটে ঘরে দল পরিচালনা করে থাকে তারা। জাস্টিন ট্রুডোর বাবার সাথে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় সম্পর্ক ছিল
।
গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে পঁচাত্তর বছরে পদার্পণ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিষ্ট নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আগামী ২৩শে জুন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই ও সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে দলটি। ভাঙা-গড়া ও দমন-পীড়নের সম্মুখীন হয়েছে। আজ দলটি শক্ত অবস্থানে উন্নীত, সুদিন চলছে। পথপরিক্রমায় ফের দলটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে পারে।
কুদিনের বিষয় বিবেচনা করলে দলটির জন্য তৃণমূলস্তরে স্থায়ী কার্যালয় দরকার। বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থায়ী কার্যালয় করতে হবে। এজন্য নিজস্ব ভূমি দরকার। দেশে শিল্পায়ন ও নগরায়ন হচ্ছে। জমির ওপর চাপ পড়ছে। তাই পরিকল্পিতভাবে ভূমির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে দলটি ১০ কাঠার ওপর ভবন নির্মাণ করতে পারে। যেটা ভুতলে দোতলা ও উপরিতলে দশতলা হতে পারে। জেলায় ৫ কাঠা জমিতে একই কায়দায় অফিস নির্মাণ করতে পারে। উপজেলায় তিন কাঠায় মাটির ওপরে বারো তলা ও নিচে তিনতলা স্থাপনা করতে পারে। এই হিসাবটা দেশের ১২ কোটি মানুষের জন্য। আমি দেশের মানুষের সংখ্যা ১২ কোটির মধ্যে রাখার পক্ষপাতি। যদি দল কখনও বিপদে পড়ে, তখন এই স্থায়ী অফিস দলের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ হবে। পরিবেশের যেন ক্ষতি না হয়, তাই সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ১২ তলার অধিক উচ্চতা সম্পন্ন অট্টলিকা করা যাবে না। অফিস অথবা জমির মালিকানা কিভাবে ঠিক হবে, সেটা দলের হাইকমান্ড নির্ধারণ করবে। কৌঁসুলিদের সহায়তা নিয়ে এ বিষয়টি নির্ধারণ হতে পারে।
আমার জানামতে, দলের অনেক নেতাকর্মী স্থায়ী কার্যালয় নির্মাণ করার পক্ষে। যশোরের অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক গোলাম জহিরুল হক লিখন। তিনি অনেক দিন ধরে চিন্তা করছেন, স্থানীয় পর্যায়ে তাদের একটি আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কার্যালয় দরকার। তারা ব্যক্তি মালিকাধীন ও সরকারি খাস জমি খুঁজছেন। তারা জমি কিনে ভবন নির্মাণ করতে চান। এভাবেই যদি দলের উচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত গঠনমূলক চিন্তার প্রসার ঘটানো যায়, তাহলে দল যদি ভবিষ্যতে বিপদেও পতিত হয়; সেখান থেকে উত্থান ঘটানো সম্ভব।
এখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় গুগলে অনুসন্ধান করলে খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক তথ্যও পাওয়া যায়। তবে দলীয় কার্যালয়ে মহাফেজখানা, সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগার স্থাপন করা গেলে সেখান থেকে প্রকৃত তথ্য উঠে আসতো। আবার তথ্য পাওয়ার চেয়ে দলীয় নেতাকর্মীর বসার স্থান একটি দলের জন্য ইতিবাচক, আশাব্যঞ্জক। যদি আসন গ্রহণের জায়গা না থাকে তাহলে কর্মীরা কোথায় বসবেন। কোথায় জমায়েত হয়ে দলীয় কর্মকান্ড নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবেন। কর্মসূচি নির্ধারণ করবেন কিভাবে? বৈঠকখানা বা কার্যালয় না থাকলে গঠনমূলকভাবে তর্ক-বিতর্ক করা যায় না। বিতর্ক-আলোচনায় উঠে আসে দলের সর্বোত্তম পন্থা-মার্গ-দর্শন।
রজনীকান্ত সেন, বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ। তাঁর অসামান্য সৃষ্টি ‘স্বাধীনতার সুখ’। বাবুই হাসিয়া কহে, “সন্দেহ কি তাই? কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়।… নিজ হাতে গড়া মোড় কাঁচা ঘর, খাসা।” ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’, তাই বলছি, স্বরাজ স্বকীয়তা স্বয়ংসম্পূর্ণতায় আকাশের মতো হোক আওয়ামী লীগ। ###
লেখক:
অজিত কুমার মহলদার, প্রাক্তন নির্বাহী সদস্য, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন। azit.mohaldar@gmail.com