রুশাইদ আহমেদ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হওয়া আবু সাঈদের পরিবারের বিরোধিতা সত্ত্বেও পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় তাঁর ভাস্কর্য রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) সৃষ্টি হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনার। এমনকি সরাসরি এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের বিরোধিতাও করছেন অনেকে।
মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) আবু সাঈদকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রায় ২০ ফুট দীর্ঘ একটি ভাষ্কর্য নির্মাণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজাহারুল ইসলাম শেখ।
তাঁর ভাষ্যমতে, “এ প্রসঙ্গে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারাই নেবে। নববর্ষের শোভাযাত্রায় জুলাই আন্দোলনের চেতনা তুলে ধরার জন্য এই আয়োজন করা হচ্ছে।”
তবে খোদ আবু সাঈদই ভাস্কর্য রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন সবসময়। ফলে বিষয়টির বিরোধিতা করছেন অনেক শিক্ষার্থী। গত বছরের এপ্রিলে ভাস্কর্য নির্মাণের সংস্কৃতির বিরোধিতা করে আবু সাঈদ নিজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক খোকন ইসলাম বলেন:
❝বর্তমানে আওয়ামী রেজিমে গড়ে ওঠা ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতির প্রতি যে ঘৃণাবোধ তৈরি হয়েছে, তার বাইরে গিয়েই আমাদের নতুনভাবে চিন্তা করা উচিৎ। সে হিসেবে আপামর বাঙালি সংস্কৃতির একটা বড় জায়গাজুড়ে থাকা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রে শহীদ আবু সাঈদকে নিছক পণ্য বানানোর পদক্ষেপকে কেউই সমর্থন করবেন না।❞
খোকন যোগ করেন, শহীদ আবু সাঈদ নিজেও ব্যক্তিপূজা এবং অহেতুক ভাস্কর্যভিত্তিক রাজনীতির বিরোধী ছিলেন। তাই সাঈদের পরিবারের বারণ ও গ্রাউন্ড রিয়্যালিটি উপেক্ষা করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় তাঁর ভাস্কর্য রাখার সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতারই বহিঃপ্রকাশ।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. কামরুল ইসলাম শান্ত বলেন, “শহীদ আবু সাঈদকে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তবে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আমাদের এমন কিছু করা উচিত নয় যা তাঁর ও তাঁর পরিবারের ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা আদর্শের বিরোধী হয়। তাঁর পরিবার খোলামেলাভাবে জানিয়েছে, আবু সাঈদ একজন মুসলিম এবং তাঁর মূর্তি নির্মাণ তাঁদের মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমনকি আবু সাঈদ নিজেও তাঁর ফেসবুক পোস্টে সমগ্র মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে লিখেছিলেন বেঁচে থাকতে। আর সেখানে শোভাযাত্রায় তাঁর ভাষ্কর্য নির্মাণ তাঁর আত্মাকে অবমাননা করার শামিল।”
এ প্রসঙ্গে আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন বলেন:
❝ভাস্কর্য নির্মাণের বিষয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিনের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, ভাস্কর্য নয়, এক ধরনের প্রতীকী স্থাপনা নির্মাণ করা হতে পারে। তবে আমাদের পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কোনো ধরনের ভাস্কর্য বা প্রতীকী নির্মাণ অনুমোদন আমরা দেবো না। শিগগিরই কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে পুনরায় জানাবো আমরা।❞
এর আগে গত বছরের ৮ আগস্ট ‘দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান’ শীর্ষক এক উন্মুক্ত বিবৃতিতে শহীদ আবু সাঈদের পিতা মকবুল হোসেন বলেন, আপনারা সকলে জানেন, আমাদের আবু সাঈদ গত ১৬ জুলাই স্বৈরাচারের দোসরের গুলিতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, অনেকে শহীদ আবু সাঈদের ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। সাঈদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আপনারা এমন উদ্যোগ নিয়েছেন বলে আমাদের বিশ্বাস। আপনাদের ভালোবাসাকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু আমার ছেলেটাকে কত কষ্ট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে আপনারা দেখেছেন। আমি চাই না আমার ছেলে দুনিয়াতে যেমন কষ্ট পেয়েছে, আখিরাতেও তেমন কষ্ট পাক।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমরা মুসলমান। আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করি। যেহেতু ইসলাম ধর্মে সব মূর্তি, ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি বানানো নিষিদ্ধ, সেহেতু আপনাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি—দেশের কোনো স্থানে আমার ছেলের মূর্তি, ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি যেন না বানানো হয়। আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, আমার ছেলের জন্য যদি কিছু করতেই চান, তাহলে জনকল্যাণমুখী এমন কিছু কাজ করুন যার সওয়াব আবু সাঈদ কবরে পাবে।