গত জুলাই মাসব্যাপী দেশজুড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে হওয়া আন্দোলন আগস্টের শুরুতে এসে সরকার পতনের আন্দোলনে রুপ নিলে জনগণের তোপের মুখে দেশত্যাগ করে সরকার প্রধান। শেখ হাসিনা সরকারের এই বিলুপ্তির সাথে সাথে দেশব্যাপী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদত্যাগ করতে শুরু করেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্য, প্রক্টর, প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যসহ কয়েকটি হলের প্রভোস্ট ও ওয়ার্ডেন স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার শুরুতেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদেরকে অযৌক্তিকভাবে অসহযোগিতা করে আন্দোলনকে স্তিমিত করার প্রচেষ্টা করে স্বৈরাচার সরকারের দোসর হিসেবে ভূমিকা রাখার অভিযোগ এনে চিহ্নিত কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন নামে শিক্ষার্থীরা। এতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তারা।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড নূরুল আলম, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর শেখ মো: মনজুরুল হক (প্রশাসন), প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ (শিক্ষা), ট্রেজারার অধ্যাপক রাশেদা আখতার, রেজিস্ট্রার ও রিটার্নিং কর্মকর্তা আবু হাসান, প্রক্টর অধ্যাপক ড মোহাম্মদ আলমগীর কবীরসহ প্রশাসনিক দশজনেরও বেশি কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কামাল উদ্দিন হলের প্রভোস্ট আ স ম ফিরোজ উল হাসান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ইস্রাফিল আহমেদ, মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক সাব্বির আলম, শহীদ সালাম বরকত হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক সুকল্যাণ কুমার কুন্ডু,শহীদ রফিক জব্বার হলের প্রভাস্ট অধ্যাপক শাহেদ রানা, শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট হোসনে আরা, শহীদ তাজউদ্দীন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর কবীর, শেখ রাসেল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মো. তাজউদ্দিন শিকদারসহ বেশ কয়েকটি হলের প্রভোস্ট ও ওয়ার্ডেন পদত্যাগ করেছেন। এভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অব্যাহতিতে একেবারেই ব্যক্তি শূন্য হয়ে পড়েছে পদগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতিতে ক্লাস-পরীক্ষাসহ অন্যান্য কার্যক্রম স্বাভাবিক পর্যায়ে না থাকায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের অনিরাপত্তা বিরাজ করছে যা নিয়ে শঙ্কিত তারা। এমন নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই ঘটছে নানান অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যা শিক্ষার্থীদেরকে আরও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে।
গত শনিবার রাতে এক ছাত্রীকে যৌন হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে।এতে অভিযুক্ত নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শাফায়াত ইকবাল মৃধা তার অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়াও গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে মাদকসেবনরত অবস্থায় চারজনকে হাতেনাতে ধরেছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা ব্যক্তিদের না থাকাকেই কারণ হিসেবে দায়ী করছেন সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দ।
এ বিষয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রুশনাত রামিসা বলেন, প্রশাসনিকহীন এই অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নারী শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।আমরা চাই দ্রুত এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সকল দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ দেয়া হোক। পাশাপাশি এই ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হোক।
লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া জামান প্রীতি বলেন, ‘’আমি বাংলাদেশের ছোট একটা শহর থেকে উঠে এসেছি। আমার কাছে একসময় ক্যাম্পাস ছিল সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি ও প্রশাসনের ব্যর্থতায় নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠে। এমনকি মেয়েদের জন্য হলেও নিরাপত্তাশঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু এখন আমাদের ক্যাম্পাসে কোনো প্রক্টরিয়াল বডি ও প্রশাসক না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ জানানোর আর কোনো উপায় নেই। আমরা চাই দ্রুত ক্যাম্পাসের দায়িত্বশীল সকল পদে নিয়োগ দান করে আমাদের ক্যাম্পাসকে পুনরায় নিরাপদ করা হোক।
দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “গত ৭ আগস্ট উপাচার্য এবং পরবর্তীতে দুইজন সহ-উপাচার্য ও ট্রেজারার পদত্যাগ করার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, যা শিক্ষার্থীসহ পুরো ক্যাম্পাসে সকলের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি তৈরি করেছে।” বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ধরনের প্রশাসনিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম ও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনিক পদসমূহে অনতিবিলম্বে সম্ভাব্য যোগ্য, সৎ এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া জরুরি।
ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নয় দফা দাবি আদায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপরিবেশ বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কার্যকরী প্রশাসন দরকার । আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কে আহ্বান করবো দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কাঠামো ফিরিয়ে আনার জন্য।
সার্বিক বিষয়ে বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শামীমা সুলতানা বলেন, দেশে বর্তমানে ক্রান্তিকাল চলছে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও প্রক্টরিয়াল বডি পদত্যাগ করেছে। ফলে একটা নিরাপত্তাশঙ্কার তৈরি হয়েছে। তবে যতদিন না অব্দি নতুন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি না হয় ততদিন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে। সকলে মিলে সকলের বিপদে এগিয়ে আসতে হবে এবং নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষায় সচেষ্ট থাকতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সকল সহকর্মীকে নিজেদের বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রতি যত্নশীল থাকতে হবে। সকলের প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখা উচিত। এতে আমরা কিছুটা হলেও এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হব।
এছাড়াও কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে নানাভাবে প্রতিহত করার চেষ্টায় সাবেক সরকারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ এবং সহযোগী অধ্যাপক মো. ইখতিয়ার উদ্দিন ভুঁইয়ার কক্ষে গত সোমবার তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড ফরিদ আহমদের পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন করে বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড মুনীর হোসেনের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও লোক-প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড ছায়েদুর রহমান ও জেবউননেছার পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের এভাবে তালা ঝুলিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে তাদেরকে শান্ত থেকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ইতিবাচক পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রবিউল/এমএ//