রংপুরের বদরগঞ্জে স্থানীয় বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। দোকান ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ থেকেই এ সংঘর্ষের সূত্রপাত বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আজ শনিবার (৫ এপ্রিল) দুপুরে বদরগঞ্জ পৌর এলাকার শহীদ মিনার সংলগ্ন স্থানে এ সংঘর্ষ ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম লাভলু মিয়া (৫০)। তিনি কালুপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং উপজেলা বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে তিনি মারা যান। নিহতের ছেলে রায়হান আলী তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সংঘর্ষের পেছনের ঘটনা
স্থানীয় ব্যবসায়ী জাহিদুল হকের একটি টিনের দোকান রয়েছে শহীদ মিনারের পাশে। জায়গাটির মালিক কালুপাড়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ইসতিয়াক হোসেন। জাহিদুলের দাবি, তাঁর কাছে ২০২৮ সাল পর্যন্ত বৈধ চুক্তিনামায় জায়গাটি ভাড়া রয়েছে। তবুও ইসতিয়াক হোসেন বারবার তাঁকে জায়গাটি ছাড়ার জন্য হুমকি দিয়ে আসছিলেন।
গত বুধবার সন্ধ্যায় ইসতিয়াক হোসেন বিএনপির কিছু নেতা-কর্মীকে নিয়ে দেশীয় অস্ত্রসহ দোকানে হামলা চালান বলে অভিযোগ করেন জাহিদুল। তিনি বলেন, হামলাকারীরা তাঁকে মারধর করে ও বাঁ পায়ে ছুরিকাঘাত করে। পরে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি।
এই ঘটনার পর থেকেই বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক ও স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতা সারোয়ার জাহান জাহিদুলের পক্ষে অবস্থান নেন। অন্যদিকে, সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সদস্য মোহাম্মদ আলী সরকার এবং উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবীর অবস্থান নেন ইসতিয়াক হোসেনের পক্ষে।
মানববন্ধন ঘিরে সংঘর্ষ
শনিবার দুপুরে জাহিদুলের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারের পাশে একটি মানববন্ধনের ঘোষণা দেওয়া হয়। দুপুর ১১টার দিকে মানববন্ধনের প্রস্তুতির সময় হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে শতাধিক ব্যক্তি দেশীয় অস্ত্রসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মানববন্ধনের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন। এরপরই দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়, যা চলে প্রায় এক ঘণ্টা।
সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন অন্তত ৯ জন। তাঁদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। আহত ব্যক্তিরা হলেন—শরিফুল ইসলাম (৫৫), ময়নাল হোসেন (২৫), মোক্তারুল হোসেন (৫২), মোন্নাফ হোসেন (৫০), মংলু মিয়া (৪০), মিতু হোসেন (৪২), জয়নাল হোসেন (৪৫) ও মুন্না খান (৪০)।
বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাকির মুবাশ্বির বলেন, “প্রাথমিক চিকিৎসার পর নয়জনকে রংপুর মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাঁদের মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে।”
গাড়ি ভাঙচুর, শিশুসহ আহত যাত্রী
সংঘর্ষ চলাকালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুর রহমান তাঁর পরিবারসহ ব্যক্তিগত গাড়িতে ঢাকা ফিরছিলেন। শহীদ মিনারের পাশে সংঘর্ষে জড়িতরা তাঁর গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে ফেলে। এতে গাড়িতে থাকা তাঁর আট বছরের কন্যা মাহরিন আহত হয়। হামলাকারীরা আরও অন্তত তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করে।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী সরকার বলেন, “লাভলু ছিলেন আমার আত্মীয় এবং দলের একজন নিবেদিত কর্মী। তাঁকে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হকের নেতৃত্বাধীন একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।”
তবে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনের আয়োজন করেছিলাম। প্রতিপক্ষ এসে হামলা চালিয়েছে। আমার বা আমার ছেলের (তমাল) কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”
হুমায়ুন কবীর বলেন, “আমরা কোনো হামলা করিনি, কোনো গাড়িও ভাঙিনি। বরং প্রতিপক্ষের অপপ্রচারে দলের কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। হামলা করেছে তারাই।”
মোহাম্মদ আলী সরকার আরও অভিযোগ করেন, শুক্রবার রাতে তাঁর বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যানের ছেলে তমাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন পোস্ট দেয়, যার কারণে তাঁর অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ঘটনার পর সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে শহীদ মিনার এলাকায় সেনা সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায়। সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন মেহেদী জানান, “ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বদরগঞ্জ থানার ওসি এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, “দোকানকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”