গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। এটি কেবল সংবাদ পরিবেশন করে না, বরং সমাজের অসঙ্গতি গুলো তুলে ধরে, জনমত সৃষ্টি করে এবং শাসনব্যবস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। তবে প্রশ্ন হলো, বর্তমান বাংলাদেশের গণমাধ্যম আসলেই কি এই ভূমিকা পালন করছে? নাকি এটি বিভিন্ন মতাদর্শিক এজেন্ডা ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে পরিচালিত একটি প্রোপাগান্ডা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে?
গণমাধ্যমের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর বহুমাত্রিকতা। সমাজে ভিন্ন মত প্রকাশের সুযোগ থাকলে এবং সেই ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীল মনোভাব থাকলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়। সেদিক থেকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকা নিজস্ব রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক অবস্থান থেকে কাজ করেছে। নব্বইয়ের দশকের পর গণমাধ্যমের পরিসর বেড়েছে, তবে একই সঙ্গে বেড়েছে পক্ষপাত ও বিভাজনের প্রবণতাও। এ-ই পক্ষপাত ও বিভাজনের প্রবণতা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে “জঙ্গি জার্নালিজম” নামক বিধ্বংসী সাংবাদিকতা চর্চার।
“আমার দেশ” পত্রিকার দ্বিতীয় দিনের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এই বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রতিবেদক আবু সুফিয়ানের এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) আওয়ামী আমলে কীভাবে তথাকথিত ‘জঙ্গি দমন’-এর আড়ালে রাষ্ট্রীয় হত্যা ও নির্যাতনের সংস্কৃতি তৈরি করেছিলো, তা তুলে ধরা হয়েছে। এর পাশাপাশি প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম এই প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্রীয় প্রচারণা ও মিথ্যা বিবরণী দিয়ে বৈধতা দান করছে।
যখন গণমাধ্যম রাষ্ট্রের হত্যাকাণ্ডের সাফাই গাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন এটি আর জনগণের কণ্ঠস্বর থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে আবু সুফিয়ানের প্রতিবেদনটির মতো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল রাষ্ট্রের গোপন অন্যায় উন্মোচন করে না, বরং গণমাধ্যমের ভূমিকা ও দায়িত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি করে।
অন্যদিকে, “প্রথম আলো” কে দেশের বৃহত্তম প্রোপাগান্ডা মেশিন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। “প্রথম আলো”র জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব দেশজুড়ে বিস্তৃত। প্রথম আলো দীর্ঘদিন ধরে জনমত গঠন ও মতাদর্শ বিস্তারে বিশাল প্রভাব রেখে চলেছে। এটি সরকারের ব্যর্থতা কিংবা সামাজিক ইস্যুগুলোতে কৌশলগতভাবে সমালোচনা করলেও, নীতিগত অবস্থান থেকে কখনো আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করে নি। যা বিপ্লবোত্তর জনমনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
মতাদর্শিক পক্ষপাত পত্রিকার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। “প্রথম আলো”র ক্ষেত্রে যেমন এটিকে দেশের বৃহত্তম প্রোপাগান্ডা মেশিন বলা হলেও, তারা এটি কৌশলে এড়িয়ে যায়। অন্যদিকে, “আমার দেশ” রাজনৈতিক আদর্শের কারণে স্বভাবতই বিদ্রোহী মনোভাব পোষণ করে এসেছে আজন্মকাল ধরে। তাই এটি সরাসরি আক্রমণের শিকার হয়। এই দ্বৈত অবস্থান সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বিপজ্জনক।
তবে এর মানে এই নয় যে “আমার দেশ” বা এর মতো অন্য কোনো পত্রিকা নিরপেক্ষ বা নিখুঁত। ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্ক, সংবাদমাধ্যমের ওপর প্রোপাগান্ডার মেশিন হিসেবে অভিযোগ নতুন কিছু নয়। প্রতিটি গণমাধ্যমেরই নিজস্ব এজেন্ডা, শক্তি ও দুর্বলতা আছে। সেগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি। গণমাধ্যমের ওপর কোনো রকম পক্ষপাত ছাড়াই সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করতে হবে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ে একাডেমিক পদ্ধতিতে গবেষণা করলে দেখা যায়, প্রতিটি পত্রিকার নবপ্রকাশ এবং কার্যক্রমে রাষ্ট্র, সমাজ এবং ক্ষমতার সাথে সম্পর্কের জটিলতা কাজ করে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দাঁড়ায়, গণমাধ্যম কীভাবে তার নৈতিক অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে পারে? একদিকে রাষ্ট্রের চাপ, অন্যদিকে কর্পোরেট ও রাজনৈতিক প্রভাব—এই দুইয়ের মাঝে কীভাবে গণমাধ্যম তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে?
এক্ষেত্রে পাঠকদের দায়িত্ব গ্রহন করতে হবে। তারা যদি কেবল মতাদর্শগত পক্ষপাতের ভিত্তিতে সংবাদ গ্রহণ করে, তবে গণমাধ্যমে শুদ্ধতার প্রত্যাশা করা অবাস্তব। তাই প্রতিটি মিডিয়াকে কেস বাই কেস স্টাডি করতে হবে পাঠকদের। নির্দিষ্ট মতাদর্শ, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির বাইরে এসে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সংবাদ গ্রহন করতে হবে।
মতাদর্শিক পক্ষপাত, কর্পোরেট ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে অনেক পত্রিকাই মূল সাংবাদিকতার জায়গা থেকে দূরে সরে এসেছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম শিল্পে অনুসন্ধানী ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার চর্চা আরো বাড়াতে হবে। গণমাধ্যম যদি জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করতে চায়, তবে তাকে প্রোপাগান্ডার জায়গা ছাড়তে হবে এবং সত্য অনুসন্ধানের পথে হাঁটতে হবে। এটিই একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজের পূর্বশর্ত।