দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ থেকে প্রায় ৫৩ বছর আগে বিশ্বের বুকে ভূমিষ্ঠ হয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই বাংলাদেশ তথা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো।
পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকায় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার দ্বারা উদ্দীপিত হওয়ায় স্বভাবতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার নীতি গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার খাতিরে একই পথে হাঁটে চীনও। এর বিপরীতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন (অধুনা রাশিয়া) ও আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশ অবস্থান নেয় বাংলাদেশের পক্ষে।
আপাতদৃষ্টিতে তখন বিশ্বের মোড়লদের বাংলাদেশের পক্ষ নেওয়া বা না নেওয়ার ক্ষেত্রে জোটকেন্দ্রিক প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও, স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’ ঘরানার পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের সূত্র ধরে ক্রমে ক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অন্যান্য দেশও ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত প্রায় দেড় লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই ক্ষুদ্র বদ্বীপটির হঠাৎ করে বিশ্বের ভূরাজনীতিতে উত্থানের পেছনে আসল রহস্য বা কারণগুলো কী? এই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের চ্যালেঞ্জসমূহের দিকে আলোকপাত করা যাক্।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান
ভূরাজনৈতিকভাবে বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পেছনে প্রথম রহস্য হলো এর ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের গোটা পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তজুড়ে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। পাশাপাশি, উত্তরে আরও আছে আসাম ও মেঘালয়। পূর্বে রয়েছে আসামের কিয়দংশ এবং ত্রিপুরা ও মিজোরাম প্রদেশ। আর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের পরিব্যাপ্তি, যা ব্যবহার করে সারা বছর সমগ্র বিশ্বের অর্ধেক বাণিজ্যিক পণ্য পরিবাহিত হয়ে থাকে।
ভারত মূলত বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তার অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সংবলিত সাত অঙ্গরাজ্য তথা সেভেন সিস্টার্স বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে থাকায়। কেননা ঢাকার সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ব্যতীত দেশটির আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয়, অরুণাচল, ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যে স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রেখে রাজ্যগুলোর বাসিন্দাদের অন্তরে পুঞ্জীভূত চাপা ক্ষোভ সামাল দিয়ে শাসন জারি রাখা অতটাও সহজ নয়।
উপরন্তু, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ভারতের ‘চিকেন নেক’ খ্যাত শিলিগুড়ি করিডর ভুটান, নেপাল, বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত ও ভারতের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী প্রধান অঞ্চল। এই অংশটি চীন সীমান্তেরও নিকটবর্তী হওয়ায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে এক সংযোগস্থলে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যেই চীন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে।