ক্রিস ডয়েল: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বললেন যুক্তরাষ্ট্রকে “লুট, ধ্বংস, ধর্ষণ এবং লুণ্ঠন” করা হয়েছে দেশীয় এবং বিদেশি শক্তির দ্বারা, তখন তার মানে কী দাঁড়িয়েছিল? এই বক্তব্যের পর মার্কিনীরা কি কোনোভাবে ২ এপ্রিল মুক্তি পাওয়ার স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছে? আসলে, কী থেকে মুক্তি — সেটাও তো বোঝা সহজ নয়।
এ ধরনের ভাষ্যের পেছনে শুধু নজিরবিহীন ব্যাপক শুল্ক আরোপের উদ্দেশ্যই ছিল না। বরং গোটা ঘোষণাটাই ছিল অস্পষ্ট, বিভ্রান্তিকর এবং ক্ষতিকর।
বিশ্বের সব অর্থনীতিকেই এমন ধরনের ধাক্কার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়, যা হঠাৎ করে শেয়ার বাজারের পতন ঘটাতে পারে। কিন্তু নিজের হাতে নিজের আর্থিক ক্ষতি করার এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন।
এটা কোনো ছোটখাটো ঘটনা নয়। এটা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ব্রেটন উডস, সাধারণ শুল্ক ও বাণিজ্য চুক্তি (GATT) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)-এর যুগের অবসান ঘটানো।
এই পদক্ষেপের ফলে মূলত বিশ্বায়নের মৃত্যু ঘটলো এবং ১৯৩০-এর দশকের মতো রক্ষণশীলতায় প্রত্যাবর্তনের পথ তৈরি হলো। অনেক দিক থেকেই এটিকে বলা যেতে পারে সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আঘাত, যা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল, প্রতিযোগিতামূলক এবং শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত করেছিল।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার স্বভাবগত অনিশ্চয়তার কারণে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অনেকেই এখনও জানতে চাইছেন, এটা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, যেমনটা রোজ গার্ডেনে বলা হয়েছে। শেয়ার বাজারের পতনের প্রভাব থেকে নিজেও মুক্ত নন ট্রাম্প। তাঁর প্রশাসন আকস্মিক নীতিমালা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আগ্রহী। এমনকি শুল্কের ক্ষেত্রেও।
যদি এই প্রক্রিয়া এগিয়ে যায়, তাহলে এর প্রভাব কী হতে পারে?
স্পষ্টতই আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ার বিষয়ে প্রশ্ন উঠবেই। কেননা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সর্বদা আগাম পরিকল্পনা করার জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেটা কীভাবে সম্ভব? ফলে বিনিয়োগকারীদের অন্যত্র অর্থ সরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েই যায়।
আদতে এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকেই আঘাত করবে না। বরং বৈশ্বিক মন্দা, এমনকি মহামন্দার ঝুঁকিও সৃষ্টি করবে। বিশ্বের খুব কম নেতাই চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র এটা করুক। এখনও খুব কম দেশই চায় এ ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ। কিন্তু এটা এখন প্রায় অনিবার্য উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। শুধু আছে মাত্রার পার্থক্যের প্রশ্ন।
চীনের ওপর অতিরিক্ত ২০ শতাংশের পাশাপাশি ৩৪ শতাংশ যে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করেনি দেশটি। সম্ভবত ইউরোপীয় ইউনিয়নও পাল্টা পদক্ষেপ নেবে।
কিছু রাষ্ট্র আপাতত থেমে রয়েছে। যেমন যুক্তরাজ্য এখনই প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির চেষ্টা করছে, যদিও ওয়েস্টমিনস্টারে এটাকে “মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি” বলে উল্লেখ করা হয়নি। অন্যান্য রাষ্ট্রও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির চেষ্টা করতে পারে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য, কিন্তু কী ধরনের শর্তে?
এ ক্ষেত্রে আছে নানা অনিয়মও। ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ ভারত মহাসাগরের দ্বীপ রিইউনিয়নকেও ১০ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হতে হয়েছে। অথচ ইইউর ওপর আরোপিত শুল্কের হার ২০ শতাংশ। লেসোথোর মতো প্রধান হীরক রপ্তানিকারক দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর অর্থ হলো মার্কিন ভোক্তাদের এখন হীরা কিনতে হবে চড়া দামে।
আর সিরিয়ার ওপরও ৪১ শতাংশ শুল্ক বসানোর মানে কী? দশকের পর দশল ধরে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে মাত্র ১.১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল।
একইভাবে, ইসরায়েলিদেরও প্রশ্ন কেন তাদের প্রধান মিত্র এবং রক্ষক তাদের পণ্যের ওপর ১৭ শতাংশ শুল্ক বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হওয়া মিয়ানমারের ওপরও ৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
তবে এতকিছুর পরও সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো তালিকায় না থাকা কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি হলো রাশিয়া। প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে, কিন্তু ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩.৫ বিলিয়ন ডলার।
নজিরবিহীন এই শুল্ক আরোপের ঘটনা আসলে রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত অর্থনৈতিক নীতিমালার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আধিপত্য আরোপের চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। তবে এটা আদৌ কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে।
এছাড়াও, কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, ইইউ-কে ২০ শতাংশের শুল্কের মুখোমুখি করা হলেও, যুক্তরাজ্যের জন্য হার মাত্র ১০ শতাংশ। ব্রেক্সিটপন্থীরা বলছেন, এটা ব্রেক্সিটের একটি দারুণ সুবিধা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো এখন ব্রিটেনের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র — উভয়ের সঙ্গে বাণিজ্য করা আগের চেয়ে কঠিন এবং ব্যয়বহুল। তবে, এর চেয়েও জটিল হচ্ছে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিষয়টি। সেখানে প্রজাতন্ত্র আয়ারল্যান্ডের তুলনায় কম শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা ব্রেক্সিট আলোচনায় বিতর্কিত সীমান্ত সমস্যাকে আবারও উস্কে দেবে।
কিন্তু কে লাভবান হবে এতে? বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছিলেন জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান বলছেন, এর ফলে প্রবৃদ্ধি কমবে। এমনকি তার ধনী সমর্থকরাও শেয়ার বাজার পতনের ফলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন — যা কোভিড-১৯ মহামারির পর সবচেয়ে খারাপ পতন। আর ডলারের কী হবে? বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থান কি এখন দুর্বল হচ্ছে?
এই মুহূর্তে, মনে হচ্ছে বিশ্বকে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং রক্ষণশীলতার যুগে প্রবেশ করতে হবে। তাই এখন দরকার ঝড়ের মুখে পাল তোলা।