বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক বিগত কয়েক মাসে বেশ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পর থেকে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব আরও স্পষ্ট হয়েছে।
সর্বশেষ বিমসটেক সম্মেলনেও দুই দেশের সরকার প্রধানদের বৈঠকের সম্ভাবনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো বৈঠকে বসতে অনাগ্রহ প্রকাশ করায় দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনমিত পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বলে মন বিশ্লেষকদের।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ক্রমেই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে, বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। এই সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে আগামী ২৬ মার্চ চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সফরের মূল লক্ষ্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিনিয়োগ আকর্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা ও পানি ব্যবস্থাপনায় যৌথ অংশীদারিত্ব বাড়ানো। এ সফরে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানিত করাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে এই সফর বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তিনি উল্লেখ করেন, চট্টগ্রামের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এই সফরের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। সরকার আশা করছে, চীনের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থানান্তর করবে এবং এখানকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের সুযোগ নেবে।
এই সফরের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করবে। বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরের কথাও রয়েছে, যা দেশে চীনা বিনিয়োগ ও সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মুক্ত করবে।
চীনে বাংলাদেশের বাজার সম্প্রসারণ
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশ এখনো চীনের বিশাল বাজারের পুরো সুবিধা নিতে পারেনি। রফতানির জন্য পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করা হলে এই সুযোগ আরও ভালোভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। চীন যেহেতু বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি, তাই এই বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশকে নতুন পণ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবা খাতে নতুন সম্ভাবনা
স্বাস্থ্যসেবা খাতেও বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি রোগীরা ভারতের ভিসা সমস্যার কারণে চিকিৎসা নিতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ কারণে বাংলাদেশ চীনের বিভিন্ন হাসপাতালে বিশেষ চিকিৎসা সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশের রোগীদের জন্য চীনের কুনমিং শহরে চারটি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করার অনুরোধ জানানো হয়েছে, যেখানে তারা উন্নত মানের চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। ইতোমধ্যে প্রথম দফায় কিছু বাংলাদেশি রোগী চীনে চিকিৎসা নিতে গেছেন।
বাংলাদেশ সরকার চাইছে, চীন ঢাকায় একটি আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ করুক, যা ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও গভীর করবে।
তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও পানি সম্পদ উন্নয়ন
বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ইস্যু তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা। ভারত দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তাই বাংলাদেশ এখন চীনের সহযোগিতায় তিস্তা নদী পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য চীনের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। বাংলাদেশ চায়, চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্বের মাধ্যমে নদী ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে চীন সফরের তাৎপর্য
প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন চীন সফর বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান ও ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, এই সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। তবে তিস্তা প্রকল্পের মতো বড় ইস্যুগুলোর জন্য নির্বাচনের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন:
❝অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্তমানে ক্ষমতায় থাকলেও চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষরে কোনো বাধা নেই। কারণ, চীন জানে যে বর্তমান সরকার জনগণের পূর্ণ ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করছে। তাই এই মুহূর্তে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হয়ে উঠতে পারে।❞
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শাহাব এনাম খানের মতে, এই সফর বাংলাদেশের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট ও পানি ব্যবস্থাপনার মতো ইস্যুগুলোতে বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সফরের নির্ধারিত সূচি
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৬ মার্চ চীনের উদ্দেশে রওনা হবেন এবং হাইনান প্রদেশে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনে অংশ নেবেন। ২৭ মার্চ তিনি চীনের নির্বাহী ভাইস প্রিমিয়ার ডিং জুয়েশিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
২৮ মার্চ তিনি বেইজিংয়ের গ্রেট হল অফ দ্য পিপলে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এছাড়া, তিনি হুয়াওয়ের একটি প্রযুক্তি কেন্দ্র পরিদর্শন ও চীনের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেবেন।
২৯ মার্চ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে, যেখানে তিনি বক্তব্য রাখবেন। ওইদিনই তিনি দেশে ফিরে আসবেন।
ভারতের বিকল্প কি তবে চীন?
বাংলাদেশের এই চীন সফর শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি করতে চলেছে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের নতুন দিকের উন্মোচন।
ভারত ও চীনের মধ্যকার কৌশলগত প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশ তার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে এগোচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-চীন অংশীদারিত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি ও কূটনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।